মুক্তিনিউজ২৪.কম ডেস্ক: বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বর্তমান যে বৈশ্বিক মন্দা চলছে তাতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দেশের রাস্তায় রাস্তায় মারামারি শুরু হয়ে যেত। তাই দেশবাসীকে আমি অনুরোধ করব, সবাই একটু সাশ্রয়ী হোন, মিতব্যয়ী হোন।’
গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভার উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। এনইসি চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়া বৈঠকে সরকারি-বেসরকারি খাতে ব্যয় কমিয়ে সাশ্রয়ী হওয়ার নির্দেশনা দেন সরকারপ্রধান। বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘সারা বিশ্বে কিন্তু এখন এই অবস্থা বিরাজ করছে। তারপরও আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এর প্রভাব পড়বে। যেসব পণ্য আমাদের আমদানি করতে হয় সেগুলোর দাম বেড়ে গেছে। জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। একে তো করোনার কারণে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে আবার যেসব দেশে উৎপাদন হয় সেখানে দাম বেড়ে গেছে। তাই আমাদের দেশে একটু মূল্যস্ফীতি বা জিনিসের দাম বাড়বে।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকারের সমালোচনার জবাবে বলেন, ‘অনেকে সমালোচনা করবে। আমি বলব, আওয়ামী লীগ সরকার আছে বলেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এখানে যদি অন্য কেউ থাকত তাহলে দেশের যে কী অবস্থা হতো। আমরা দেশকে মুক্ত রাখতে পেরেছি।’
সরকারপ্রধান এখনই প্রয়োজন নেই এমন প্রকল্প হাতে না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যে প্রকল্প প্রয়োজন এখন সেটাই করব। আর যেটা কম প্রয়োজন, সেটা একটু ধীরগতিতে করব। যেন অর্থনীতির ওপর চাপ না আসে। এখন সারা বিশ্বে মন্দা চলছে। বিশ্ব দুর্ভিক্ষের দিকে যাচ্ছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। টাকা খরচ এবং অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের অহেতুক সম্পদের ব্যয় না করে সংরক্ষণ করতে হবে। আমরা যদি খুব ভালোভাবে হিসাব করে চলতে পারি, তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। এটা আমি বিশ্বাস করি।’
করোনা এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সারা বিশ্বের উন্নত এবং অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে এবং দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ইউরোপের অনেক দেশ আছে যেখানে ১৭ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। জার্মানির মতো জায়গায় ভোজ্য তেলের অভাব। একমাত্র অলিভ অয়েল ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় তেল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, এক লিটারের বেশি কেউ নিতে পারবে না। আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতি ৮ ভাগের ওপরে উঠে গেছে, ১০ ভাগে উঠে যাবে। ১ ডলারের ডিজেল-পেট্রলের দাম ৪ ডলারে উঠে গেছে। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে যে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য মন্ত্রিসভার সদস্যদের বলেন তিনি।
গরিব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ গেছেএটা তাদের পছন্দ না : পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নানামুখী সমালোচনার কথা টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটা সম্পন্ন হলে আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। আমাদের অর্থনীতি আরও সচল হবে এবং চাঙ্গা হবে। এটা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এত সমালোচনা কেন এটা নিয়ে? কারা কথা বলছে এ বিষয়ে। যারা এটা নিয়ে কথা বলবেন, আমার মনে হয় তাদের বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। তখন তারা বুঝতে পারবেন বিদ্যুতের কী প্রয়োজন? এই সমালোচকদের আমি বলব গরিব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ গেছে সেটা কি তারা পছন্দ করছেন না?
পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে : এ সময় পদ্মা সেতুতে রেললাইন রাখা এবং অর্থ ব্যয় নিয়ে সমালোচনার উত্তরে নানা পরিসংখ্যান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর একটি টাকাও আমরা কারও কাছ থেকে ধার করিনি বা ঋণ নেইনি। এটি বাংলাদেশের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে করা হচ্ছে। প্রথমে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কথা। তারপর এলো পদ্মা সেতুর রেললাইন। ৪০ হাজার কোটি টাকার রেললাইনের কী দরকার ছিল? কারা চলবে এই রেললাইনে। আমি অপেক্ষা করছি এই রেললাইন যখন চালু হবে তারা রেলে চলেন কিনা?
সরকারপ্রধান যোগ করেন, ‘এই মানুষগুলোকে মনে হয় ধরে নিয়ে দেখানো দরকার এই রেল সেতুতে মানুষ চলে কি না। একটি খরস্রোতা নদী। বিশ্বের সব থেকে খরস্রোতা নদী অ্যামাজান এবং এই পদ্মা। সেই নদীতে সেতু এবং সেখানে রেললাইন দিচ্ছি। সেই রেললাইন নিয়ে এত সমালোচনা! মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়। আর এখন রেলে করে তারা চলে আসবে। এই রেল তো মোংলা পোর্ট পর্যন্ত সংযুক্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এটা আমরা পায়রা পোর্ট পর্যন্ত করব। সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
দেশে প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গ : বক্তব্যের শুরুতে শেখ হাসিনা তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমার আব্বা সারা জীবন কষ্ট করেছেন, জেল খেটেছেন, আমরা তো পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যে বয়সে ছেলেমেয়ে বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, সেই সুযোগ তো আমাদের হয়নি। কারণ, আমরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জানি আমার আব্বা জেলে। কখনো এক বছর, কখনো দেড় বছর, তারপর আবার জেলে। জেলখানায় আমাদের দেখা হয়। এভাবে আমাদের জীবন কেটেছে। তিনি যা করেছেন এ দেশের মানুষের জন্য করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলযে আকাক্সক্ষা নিয়ে তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন…সেই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর, সেটা আমাদের করতেই হবে। আর সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি বাংলার মাটিতে ফিরে আসি।’ তিনি বলেন, ‘যেদিন এয়ারপোর্টে নামি কোনো আপনজনের চেহারা পাইনি। কিন্তু পেয়েছিলাম লাখো মানুষের ভালোবাসা। আর এটাই আমার একমাত্র শক্তি। সেই শক্তি নিয়ে আমি চলেছি।’
কিছু পত্রিকা এক দিন ভালো লিখলে ৭ দিন লেখে খারাপ : পত্রিকার সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশের কিছু পত্রিকা এক দিন ভালো লিখলে পরের ৭ দিন খারাপ লিখবে।’ সরকারি কর্মকর্তাদের এটা নিয়ে না ঘাবড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘ওই পত্রিকা দেখে ঘাবড়ানোর কোনো দরকার নেই। আর পত্রিকা পড়েও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই। সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশের কথা চিন্তা করে। দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করে। এটা তাদের চরিত্র। আমি চিনি সবাইকে।’
নিজে পত্রিকা পড়ে সিদ্ধান্ত নেন না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘হাইস্কুল থেকে তো রাজনীতি করি। সবাইকে আমার চেনা আছে। সব পরিবারকেও চেনা আছে। পত্রিকা পড়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার নেই। আমি সেভাবেই চলি। সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চলছি বলেই আজকে দেশটা এগিয়ে যাচ্ছে। আমি যদি ভয়ে ভয়ে থাকতাম, ও কী লিখল, ও কী বলল, ও কী করল; তাহলে কোনো কাজ করতে পারতাম না। নিজের বিশ্বাস হারাতাম।’ তিনি এ সময় একটি বেসরকারি টেলিভিশন টক-শোর অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘কাজের ব্যস্ততার মাঝেও একদিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে টক-শো দেখলাম। কেউ কেউ দেখলাম, একটা কথা খুব প্রচার করার চেষ্টা করছে। সেটা রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র। টক-শোতে তারা টাকার অঙ্ক দিয়ে দেখাতে চাচ্ছেন যে, এত টাকা খরচ করার দরকারটা কী ছিল। কিছু লোক সবসময় সমালোচনা করাকেই অভ্যাসে পরিণত করেছেন। তারা নিজেদেরটা দেখে, নিজেদেরটা বোঝে; কিন্তু জনগণের ভালো-মন্দ বোঝে না। তবে আমরা তাদের মতো দুই-চারজন, যারা দেশের অর্থসম্পদ ভোগ করে, তাদের কথা ভাবি না; ভাবি দেশের তৃণমূলের মানুষ, যারা অসহায়, শোষিত, বঞ্চিতদের কথা। তাদের কল্যাণ যাতে হয়, আমরা সেটা দেখি। শুধু বড়লোকদের দুই-চারটা ছেলেমেয়ে কম্পিউটার ব্যবহার করবে; আর আমার গ্রামের ছেলেমেয়েরা ব্যবহার করবে না, সেটা তো হয় না।’