মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক :
রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের চারদিন পার হয়েছে। আগুনে পুড়েছে অন্তত দুই শতাধিক দোকান। ইতোমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও আগুনের কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি। আগুন কেন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছিল, তাও উঠে এসেছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে।
বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) ভোর ৩টা ৪৩ মিনিটে কৃষি মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এর ৯ মিনিট পর ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট। আগুনের ভয়াবহতায় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ইউনিটও। সর্বশেষ ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিটের চেষ্টায় সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন- মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুল মান্নান, ঢাকা জোন-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক তানহারুল ইসলাম ও ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর নাসরিন সুলতানা। তদন্ত কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আগুনের ভয়াবহতায় কৃষি মার্কেটের প্রায় ৪০০ দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মার্কেট ও কাঁচাবাজারে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৭০০-৮০০ দোকান ছিল। তবে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) দাবি, অবৈধ দোকান ছিল ফুটপাতে। সিটি করপোরেশন থেকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া ছিল ৩১৭টি। এর মধ্যে পুড়েছে ২১৭টি দোকান।
আগুন নিয়ন্ত্রণের পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন দোকান মালিক সমিতি, ব্যবসায়ী নেতারা, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী ও আঞ্চলিক কর্মকর্তা এবং ঢাকা জেলা প্রশাসক।
অন্তত দেড় ঘণ্টা আগুনের পর খবর পায় ফায়ার সার্ভিস
সোমবার(১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা অভ্যন্তরীণ কাজ শুরু করেছি। কারা কারা ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন, তাদের দোকান, দোকানের মালিকদের কাগজপত্র সংগ্রহ করছি। আগুনের সঠিক কারণ নিরূপণের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, আগুন লাগার এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর যদি ফায়ার সার্ভিস খবর পায় তাহলে তো আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিনই হবে। ফায়ার সার্ভিসকে অনেক দেরিতে খবর দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা নানাভাবে ফায়ার সার্ভিসকে দোষারোপ করতেই পারেন, কিন্তু কোথাও আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসকে না জানালে ফায়ার সার্ভিস কী করবে? দেড় ঘণ্টা পর খবর দিলে তো ফায়ার সার্ভিস দেড় ঘণ্টা পরেই যাবে।
দেরিতে খবর পাওয়ায় আগুন চলে যায় ‘ডেভেলপমেন্ট স্টেজে’
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির প্রধান অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩ টা ৪৩ মিনিটে প্রথম কল আসে ৯৯৯ থেকে। এরপর কল আসে আমাদের ১৬১৬৩ নাম্বারে। ৯৯৯ এর ডিরেক্ট কলেই মোহাম্মদপুর ও কল্যাণপুর ফায়ার স্টেশন থেকে ফাস্ট রেসপন্স করে। কিন্তু, আগুন ততক্ষণে ফায়ার সার্ভিসের ভাষায়- প্রাথমিক স্টেজ ছাড়িয়ে ডেভেলপমেন্ট স্টেজে চলে গেছে। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসকে দেরিতে খবর দেওয়া হয়েছিল। আর ডেভেলপমেন্ট স্টেজে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।
আমরা প্রাথমিকভাবে আলামত সংগ্রহ করছি। আগুনের কী কী কারণ হতে পারে সেটাও আমরা নিরূপণ করছি। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, মশার কয়েল ও বিড়ি-সিগারেট থেকে আগুন লাগতে পারে। সঠিক কারণটা নিরূপণে সময় লাগবে।
আগুনে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলেও লিঙ্কআপ আগুন ছড়াতে দেয়নি ফায়ার সার্ভিস
তাজুল ইসলাম বলেন, আগুন নির্বাপণ করতে করতে পুড়ে যায় মার্কেটের তিনভাগ। আমরা পূর্ব পাশের অংশ রক্ষা করতে পেরেছি। আমাদের সফলতা হচ্ছে লিঙ্কআপ আগুন ছড়াতে দেইনি। উদাহরণস্বরূপ, আগুনের অনেক বড় ফ্লেম ছড়াচ্ছিল, যা সন্নিকটে থাকা আবাসিক ভবনে ছড়াতে পারতো। আমরা সেটা ছড়াতে দেয়নি। ওয়াটার ব্যারিকেড দিয়ে রক্ষা করেছি। কিন্তু বঙ্গবাজারে, বরিশাল প্লাজাসহ পাঁচ জায়গায় আগুনে ফায়ার লিঙ্কআপ হয়েছিল।
ক্ষয়ক্ষতির দুটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেরিতে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়া আর বরাদ্দকৃত একটি দোকানের পজিশনকে ভেঙ্গে ৩/৪টা দোকান করা হয়েছিল। যার কারণে ক্ষয়ক্ষতির এত ব্যাপকতা।
‘দোকানের উপরে দোকান, অলিতে দোকান, গলিতেও দোকান। যে কারণে দ্রুত আগুন ছড়িয়েছিল। আর একাধিক স্থানে বেশ কয়েকটি দোকানে নাকি আগুন লেগেছিল। সেটার সত্যতা নিশ্চিতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে।’
ব্যবসায়ীদের দাবি- বিদ্যুতের লোড কম ছিল, নাশকতার সন্দেহ
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন বেশি থাকে কৃষি মার্কেটে। রাত ১০টার পরে বিদ্যুতের সঞ্চালন মার্কেটে বন্ধ করে দেওয়া হয়। যখন লোড বেশি থাকে তখন সাধারণত শর্ট-সার্কিট হয় না। এ ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগুন যখন লাগার তখনও লাগলো না। লাগলো তখন যখন বিদ্যুতের লাইনও বন্ধ। রাত ১০টার পর শর্ট-সার্কিট হবে কীভাবে? এই আগুনে চক্রান্ত আছে। নাশকতা নাকি সুনির্দিষ্ট কারণে কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত তা তদন্তেই বেড়িয়ে আসবে উল্লেখ করে লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের লাইন যদি বন্ধই থাকবে, তবে সিকিউরিটি লাইট জ্বলছিল কীভাবে? সেটার নিশ্চয় আলাদা লাইনে ছিল না। তবে ওনারা যেটা দাবি করেছেন, সেটা যৌক্তিক যে লোড কম ছিল। কিন্তু দিনে আগুন লাগলে কেউ না কেউ নির্বাপণে এগিয়ে আসেন, কাজ করেন। আগুনকে প্রাথমিক স্টেজেই নির্বাপণ সম্ভব হয়। কিন্তু, রাতে বা ভোরে তো সাধারণত কেউ থাকেন না। তখন আগুন লাগলে সেটা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। যেমনটা আমরা দেখেছি নিউমার্কেটে। বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে কীভাবে আগুন লেগেছিল যা সিসিটিভি ফুটেজে উঠে এসেছিল। এর আগে অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে আসার পর ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, কৃষি মার্কেটে কোনো ফায়ার সেফটি ছিল না। প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ফুটপাত ও সড়কে থাকা দোকান ও মানুষের কারণে অগ্নিনির্বাপণে সমস্যা হয়েছে। এখানে পানিরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বলেন, মার্কেটটিকে বারবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে গণসংযোগ করা হয়েছে। সচেতনতার প্রোগ্রাম যেভাবে আমরা করেছি সেভাবে তারা সাড়া দেয়নি। এই মার্কেটটা কিছুটা বঙ্গবাজার টাইপের। এখানে ভেতরে অনেক সাবওয়ে ছিল ছোট ছোট। ছোট ছোট এসব রাস্তা এবং বাইরের যত রাস্তা... সবগুলোই বিভিন্ন মালামাল গাদাগাদি করে রেখে বন্ধ করা ছিল এবং পুরো মার্কেট বেশ টাইট এবং গেট দিয়ে আটকানো ছিল। একইদিন পরিদর্শনে এসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ২১৭টি দোকানের তালিকা পেয়েছি। অবৈধ দোকানগুলো ছিল ফুটপাতে। আমাদের বরাদ্দ দেওয়া দোকান ছিল ৩১৭টি। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমরা তাদের তালিকা করছি। আমরা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তাদের পাশে দাঁড়াব। আমাদের কর্মীরা কাজ করছে। যতটুকু সম্ভব ডিএনসিসির পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, ডিএনসিসির পক্ষ থেকে আগে কৃষি মার্কেটে ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা পরিদর্শন করা হয়েছিল। কিন্তু, আমরা ফায়ার সেফটি পাইনি। আগুন লাগলে নেভানোর ব্যবস্থা যেন থাকে সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আগেই বলা হয়েছিল। কিন্তু, মার্কেট কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তবে ঢাকা মহানগর ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান টিপু দাবি করেছেন, ফায়ার সার্ভিস কিংবা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই ফায়ার সেফটি বাড়ানোর বিষয়ে কিংবা ‘মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ’ এমন নোটিশ ব্যবসায়ীরা পাননি। তার দাবি, আগুনে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ৪০০ দোকানের মধ্যে পুড়েছে প্রায় তিন শতাধিক। দোকান মালিক নয়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
প্রকাশক ও সম্পাদক
মোস্তাকিম সরকার
অফিস: বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি আদাবর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
বিজ্ঞাপন: ০১৭১৬-৬৪০০৬৯, বার্তা কক্ষঃ ০১৭৩১২৪৪৭৬০
Email: editormuktinews24@gmail.com, info@muktinews24.com
© 2023 মুক্তিনিউজ২৪. All rights reserved