সোহেল সানী : কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দিনাজপুরের পার্বতীপুরে শ্রীমতি পুতুল রানী। শুধু পুতুল রানী, শিক্ষা পোদ্দার কিংবা সোনা রানী রায় নয়। পুতুল রানীকে দেখে আশপাশের অনেকেই এই সার উৎপাদনে মনোযোগী হচ্ছেন। বর্তমানে এই গ্রামের প্রায় ১৫-২০ জন উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিক ভাবে জৈব সার উৎপাদন করছেন। কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) উৎপাদন করে উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের বড়হরিপুর পোদ্দার পাড়া গ্রামের শ্রীমতি পুতুল রানী কৃষকদের কাছে এখন পরিচিত নাম। তার তৈরিকৃত কেঁচো সার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পুতুল রানী কে দেখে গ্রামের অনেক যুবক ও নারীরা এখন ঝুঁকে পড়ছেন বিষমুক্ত কেঁচো বা জৈব সার উৎপাদনে।
উদ্যোক্তা পুতুল রানী বলেন, ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়ার খরচ দিয়ে যাচ্ছি এই কেঁচো সার বিক্রি করে। প্রতি কেজি সার ১৫-২০ টাকায় বিক্রি করা যায়। পার্বতীপুর উপজেলা কৃষি বিভাগ, ফুলবাড়ী, চিরিরবন্দর, গ্রাম বিকাশ, পানের বহরসহ স্থানীয় কৃষকরাই এসব সার কিনে নেয়। ২০১৮ সালে তিনি স্থানীয় উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে কেঁচো সার ও কুইক কম্পোস্ট সার তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কাজে লাগিয়ে পুতুল রানি বাড়ির আঙিনায় দুটি রিংয়ে কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে গত ৬ বছর আগে ২টি রিং দিয়ে ৩০টি কেঁচো দিয়ে সার তৈরি শুরু করেন তিনি। তার খামারের নাম দিয়েছেন ‘বড়হরিপুর সিআইজি মহিলা ফসল সমবায় সমিতি লিঃ’। শ্রীমতি পুতুল রানি বলেন, কৃষি অফিসের পরামর্শে কেঁচো সার তৈরি শুরু করি। কেঁচো সার তৈরিতে ৩৫-৪০ দিনের মতো সময় লাগে। গোবরের মধ্যে কেঁচো ডিম দেয় এবং সেখান থেকেই কেঁচো জন্মে ৭ থেকে ৮টা। বর্তমান তার কেঁচোর পরিমান প্রায় ৩০ লাখ উপরে। তবে, কেঁচোর পরিমাণ বেশি হলে সময়ও কম লাগে। এরপর নেট (জাল) দিয়ে চালাই (ঝেড়ে) করে কেঁচো পৃথক করা হয়। প্রতিটি রিং থেকে প্রায় ৪০ কেজি কেঁচো সার হয়। আর প্রতিমাসে ৬০টি রিং থেকে ২০০০-২৪০০ কেজি সার হয়ে থাকে। প্রতিকেজি সার ১৫ টাকা দরে বিক্রি করে খরচ বাদে প্রতি মাসে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা পেয়ে থাকি। এ ছাড়া প্রতি কেজি কেঁচো ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।
শ্রীমতি পুতুল রানি স্বামী কৃষক প্রভাষ রায় বলেন, আমরা দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে সেই ক্ষেতে মরিজ, শরিষা, আলু, পোটল, শিম, কপি ও করলা উৎপাদনে তিনি এ সার ব্যবহার করেন বলেও জানান। এবছর এক বিঘা জমির মরিজ বিক্রি করেছেন ১ লাখ টাকা, আলু ৫০ হাজার টাকা, পোটল ৬০ হাজার টাকা, কপি ৫০ হাজার টাকা, শিম ১০ হাজার ও করলা ৩০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। এ থেকে তাদের বছরে আয় হয় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা।
পার্বতীপুর উপজেলা কৃষি বিভাগ গত রবিবার বিকেলে পুতুল রানীর কাছ থেকে ৩ হাজার ৭শ’ কেজি কেঁচো সার কিনেছেন। গত মার্চ মাসে তিনি ৩৩ হাজার টাকার কেচো সার বিক্রি করেছেন।
কৃষক প্রভাষ রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি পুতুল রানি বলেন, ইদুর, টিকটিকি ও আরশোলা যাতে কেঁচোকে খেয়ে নিতে না পারে এজন্য প্রতিটি রিং চট, ছালা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখি। নিয়মিত রিংয়ে রাখা গোবর উল্টে দেয়াসহ আনুষঙ্গিক আমার একাজে স্বামী, ছেলে ও মেয়ে সহযোগিতা করে থাকে। একাজ করতে গিয়ে প্রথমে একটু ভয় হতো। ঠিক মতো খাবারও খেতে পারতাম না। কিন্ত এখন সে ধরনের সমস্যা আর নেই।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর তথ্য মতে, মাটিতে জৈব সার ব্যবহার বাড়ালে মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা বাড়বে। ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার মাটিকে নরম করা ও পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন অনুজীবের বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান গ্রহণের আয়নে পরিণত করে জৈব সার। এতে থাকে ৮৮.৩২ ভাগ জৈব পদার্থ, ১.৫৭ ভাগ নাইট্রোজেন, ১.২৬ ভাগ বোরন, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম। রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে এই উপাদানগুলোর পরিমাণমতো ও ক্রমেই ভূমির উর্বরতা কমে যেতে থাকে।
বড়হরিপুর পোদ্দার পাড়া গ্রামের ষষ্ঠি কুমার বাধন পোদ্দার বলেন, এ বছর কেঁচো সার দিয়ে ধান ও মরিচের আবাদ করেছি। ফলনও অনেক ভালো হয়েছে।
পার্বতীপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো: রাকিবুজ্জামান বলেন, আমরা কৃষকদের জৈব সার ব্যবহারে এবং কৃষকদের রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে কম্পোস্ট সারের ব্যবহার বাড়াতে পরামর্শ দিয়ে থাকি। দীর্ঘদিন থেকে জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করায় মাটি তার গুণাগুণ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে। ফলে মাটিতে জৈব সারের অভাব দেখা দিয়েছে। বর্তমান সময়ে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মধ্যে কেঁচো সার উৎকৃষ্ট। এসার জমিতে ব্যবহার করলে মাটি তার প্রাণ ফিরে পায়। তিনি আরও জানান, উপজেলায় এনএটিপি প্রকল্পের আওতায় পুতুল রানীকে ১৬ টা রিং, সেড, ৪ কেজি কেঁচো সার দিয়ে তৈরির কৌশল শেখানো হয়।
প্রকাশক ও সম্পাদক
মোস্তাকিম সরকার
অফিস: বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি আদাবর, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
বিজ্ঞাপন: ০১৭১৬-৬৪০০৬৯, বার্তা কক্ষঃ ০১৭৩১২৪৪৭৬০
Email: editormuktinews24@gmail.com, info@muktinews24.com
© 2023 মুক্তিনিউজ২৪. All rights reserved