বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মাতৃমৃত্যুহার কিছুটা কমলেও তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) থেকে অনেক দূরে। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। কিন্তু এখনো অনিরাপদ মাতৃত্ব ও সন্তান প্রসবের কারণে দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ জন মা মারা যাচ্ছেন। গত পাঁচ বছরে মাতৃমৃত্যু ২৯ জন বা ১৮ শতাংশ কমেছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৫৩। ২০২১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৬৮।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যে সংখ্যক মাতৃমৃত্যু কমছে, সেটার একটা বড় কারণ ইপিআই বা টিকাদান কর্মসূচি। আগে অনেক মা ধনুষ্টংকারে মারা যেত, টিকাদান কর্মসূচির কারণে তারা আর মানা যাচ্ছে না। আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের ফলে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে অনেকে অনাবশ্যক সিজারিয়ান করে। তাতে অন্তত কিছু জীবন বাঁচে, এটাও সত্যি। এগুলোর কারণে মাতৃমৃত্যুর সূচক একটু উন্নতি করেছে। কিন্তু মাতৃমৃত্যু হার ৭০-এ নামানো কঠিন। কেননা যে হারে মাতৃমৃত্যু কমছে, তাতে কিছু মৃত্যু কমানো যাবে না। কাজেই মাতৃমৃত্যু হার আর বেশি কমানো যাবে না।’
সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৩ থেকে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে মাতৃস্বাস্থ্যের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
এমন অবস্থায় আজ দেশে পালিত হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য : ‘হাসপাতালে সন্তান প্রসব করান, মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচান।’ বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
৬১% অন্তঃসত্ত্বা প্রসব-পূর্ব সেবা পাচ্ছেন না : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, প্রসব-পূর্ব চারবারের বেশি সেবা পান ৩৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী। অর্থাৎ ৬১ শতাংশ গর্ভবতী এখনো এই সেবা পান না। এই সেবার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে গ্রামের গর্ভবতীরা। গ্রামের গর্ভবতীকালীন স্বাস্থ্যসেবা পান না ৬৪ শতাংশ গর্ভবতী ও শহরে ৪৩ শতাংশ। তবে ২ শতাংশ নারী এখনো একবারের জন্যও এই সেবা নেয়নি।
স্বাভাবিক প্রসব কমেছে, সিজারিয়ান বেড়েছে : দেশে স্বাভাবিক সন্তান প্রসবের হার গতবছরের চেয়ে এ বছর ১০ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ ২০২২ সালে যেখানে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব হতো ৫৯ শতাংশ মায়ের, সেখানে ২০২৩ সালে তা কমে ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
একইভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার বেড়েছে ১০ শতাংশ। ২০২২ সালে যেখানে দেশে ৪১ শতাংশ মায়ের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হতো, সেটা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ শতাংশে।
৩৬% প্রসব বাড়িতে : গত এক বছরে যদিও বাসা বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার ৯ শতাংশ কমেছে। কিন্তু এখনো মোট প্রসবের ৩৬ শতাংশই হচ্ছে বাসা-বাড়িতে অনিরাপদভাবে। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বাসা-বাড়িতে সন্তান প্রসব হচ্ছে ১৪ শতাংশ বেশি। গ্রামাঞ্চলে মোট প্রসবের ৩৬ শতাংশই হচ্ছে বাসা-বাড়িতে ও শহরাঞ্চলে ২২ শতাংশ।
অন্যদিকে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সন্তান প্রসব হচ্ছে ২৬ শতাংশ মায়ের, যা বাসা-বাড়িতে প্রসবের চেয়ে ১০ শতাংশ কম। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবের হার ১০ শতাংশ বেশি। গ্রামে ২৪ শতাংশ মা ও শহরে ৩৪ শতাংশ মায়ের সন্তান প্রসব হচ্ছে সরকারি হাসপাতালে।
গত এক বছরে বেসরকারি হাসপাতালে সন্তান প্রসব ৭ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে সর্বোচ্চ সন্তান প্রসব হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে, যা মোট প্রসবের ৪০ শতাংশ। অথচ ২০২২ সালেও এই হার ছিল ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শহরাঞ্চলে বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪৩ শতাংশ ও গ্রামাঞ্চলে ৩৯ শতাংশ মায়ের সন্তান প্রসব হচ্ছে।
শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে : নবজাতক, এক বছরের কম বয়সী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু তিন ক্ষেত্রেই মৃত্যুর হার বাড়তি। ২০২২ সালে দেশে এক বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার ছিল হাজারে ২৫ জন, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ২৭। পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২১। এই বয়সী শিশু বেশি মারা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে ২৮ জন ও শহরে ২৪ জন।
অন্যদিকে এক মাসের কম বয়সী নবজাতকের মৃত্যুহার হঠাৎ বেড়ে গেছে। প্রতি ১ হাজার জীবিত নবজাতকের মধ্যে ২০ জন মারা যায়। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৬। পাঁচ বছর আগে ছিল ১৫। এই বয়সী শিশুও বেশি মারা যাচ্ছে গ্রামাঞ্চলে ২০ জন ও শহরে ১৬ জন।
এ ছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার বেড়ে প্রতি হাজারে ৩৩ জন হয়েছে। ২০২২ সালে ছিল ৩১ জন। পাঁচ বছর আগে ছিল আরও কম, ২৮ জন। এই বয়সী শিশুও বেশি মারা যাচ্ছে গ্রামে প্রতি হাজারে ৩৪ জন ও শহরে ৩০ জন।
শিশু মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এর অর্থ দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন সেবা, প্রসবকালীন সেবা ও প্রসবোত্তর সেবা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আটবার প্রসব-পূর্ব সেবা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু দেশের ৬০ শতাংশ গর্ভবতী চারবারও প্রসব-পূর্ব সেবা পান না। দেশে এখনো ৩৩ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে।
বাল্যবিয়ে ও কিশোরীদের গর্ভধারণ বেড়েছে : নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি বাল্যবিবাহ বেড়েছে। ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে বিবাহের হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। ২০২২ সালে এই হার ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে এই হার ৯ শতাংশ ও শহরে ৭ শতাংশ। অন্যদিকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায় ৪২ শতাংশ নারীর। ২০২২ সালে এই হার ছিল ৪১ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে এই হার ৪৪ শতাংশ ও শহরে ৩৪ শতাংশ।
একইভাবে বেড়েছে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভধারণ হার। গত ২০২২ সালে কিশোরীদের গর্ভধারণের হার ছিল ৪২ শতাংশ, এখন তা বেড়ে ৪৪ শতাংশ হয়েছে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, বাল্যবিয়ে বেড়েছে। কিশোরীদের গর্ভধারণ বাড়ছে। মাতৃমৃত্যুকে দুইভাগে ভাগ করলে দেখা যাবে যে কিশোরী গর্ভবতী ও এর বাইরে যে মাতৃমৃত্যু, সেখানে কিশোরী গর্ভবতীদের মৃত্যু বাড়ছে। এসব জায়গায় আমাদের অনেক কাজ করার আছে।
মাতৃমৃত্যুর তিন প্রধান কারণ : অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ জানান, মাতৃমৃত্যুর প্রধান তিন কারণের মধ্যে একটি একলামসিয়া বা গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি হওয়া। সরকারি হাসপাতালে এটার সুন্দর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয় কারণ প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী রক্তপাত। এতে এক তৃতীয়াংশ মা মারা যান। ডেলিভারি যদি হাসপাতালে করা যায় তা হলে এই রক্তপাত কমানো যেতে পারে ও রক্তপাত হলেও রক্ত দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। তিন নম্বর হলো সংক্রমণ। প্রসব-উত্তর ও প্রসব-পরের সংক্রমণে ১ শতাংশ মা মারা যান। একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে প্রসব হলে এটাও কমানো যায়।
দরকার সুসংগঠিত ও সমন্বিত ব্যবস্থা : দেশে নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য সুসংগঠিত ও সমন্বিতভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটির (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা দেশ রূপান্তরকে বলেন, নিরাপদ মাতৃত্বের ছয়টি স্তম্ভ আছে। এর মধ্যে প্রসব-পূর্ব সেবা, প্রসব-পরবর্তী সেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও সংক্রমণ প্রতিরোধ মূল। এসব সেবা যদি একসঙ্গে সমন্বিতভাবে উন্নতি না হয়, তা হলে যেখানে আছি, সেখানেই থাকব। মাতৃমৃত্যু কমেছে, কিন্তু অন্য সূচকগুলো তো বেড়েছে। এর মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা সেবার উন্নতি হয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধও কমেছে। কিন্তু প্রসব-পূর্ব ও পরবর্তী চেকআপ, বিশেষ করে প্রত্যেক গর্ভবতীর যে চারটি চেকআপ দরকার, সেটা বাড়েনি। বাড়িতে প্রসব যতখানি কমার কথা ততটা কমেনি। এই সূচকগুলোই এখন সমস্যা।
অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে সুসংগঠিত কাজ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমএনসি অ্যান্ড এএইচ (ম্যাটারনাল নিওনেটাল চাইল্ড অ্যান্ড এডোলসেন্ট হেলথ) সমন্বিতভাবে মাতৃ, শিশু এবং কৈশোরকালীন স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে যে ধরনের কাজ করা উচিত, সেটা হচ্ছে না। দেশে ৪৯২টা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। সেগুলোকে কেন্দ্র করে যদি মাতৃসেবা চালু করি, তা হলে বেশির ভাগ মাকেই নিরাপত্তা জালের মধ্যে আনতে পারি।