টুইটারকে চীনের উইচ্যাটের মতো বানাতে চান মাস্ক?
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : গত সপ্তাহের শুরুতে ইলন মাস্ক টুইটারের রি-ব্রান্ডিং করেছেন এক্স নামে। চীনের মেগা-অ্যাপ উইচ্যাটকে অনুকরণের যে পরিকল্পনা তিনি নিয়েছেন, এটিকে সেই লক্ষ্যে নেয়া আরেকটি পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।ইলন মাস্ক অনেক দিন ধরেই বলছেন যে তিনি তার সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিকে আমূল বদলে ফেলতে চান। গত বছর তিনি ৪৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করে টুইটার কিনে নিয়েছিলেন, এখন তিনি এই প্ল্যাটফর্মকে আরও বড় কিছুতে পরিণত করতে চান।
ইলন মাস্ক বলেছেন, তিনি যদি টুইটারকে ‘এর কাছাকাছি কিছু’তে পরিণত করতে পারেন, সেটাও হবে এক বিরাট সাফল্য।গত সপ্তাহে এক্সে এক পোস্টে মি. মাস্ক বলেছেন সামনের মাসগুলোতে তিনি এই সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপে এমন অনেক কিছু যোগ করবেন – যা দিয়ে সব ধরণের যোগাযোগের কাজ থেকে শুরু করে কোন মানুষ তার সব আর্থিক কাজ-কর্ম সারতে পারবেন।তিনি আশা করছেন এক্স অ্যাপকে এভাবে সম্প্রসারণের মাধ্যমে এটি থেকে আয় অনেক বাড়ানো যাবে। মি. মাস্ক টুইটার কিনে নেয়ার পর বিজ্ঞাপন থেকে এটির আয় প্রায় অর্ধেক কমে গেছে এবং এটি এখন ঋণের ভারে জর্জরিত।
উইচ্যাট কী? কেন ইলন মাস্ক এটিকে অনুকরণ করতে চান?
বিশাল চীনা বহুজাতিক কোম্পানি টেনসেন্ট ২০১১ সালে উইচ্যাট চালু করে। চীনের ১৪০ কোটি মানুষের প্রায় সবাই প্রতিদিন এই অ্যাপটি ব্যবহার করে। এটিকে শুধু ‘সুপার-অ্যাপ’ বললে আসলে কম বলা হয়। এর মাধ্যমে মেসেজিং, ভয়েস এবং ভিডিও কল করা যায়, একই সঙ্গে এটি আবার সোশ্যাল মিডিয়া এবং ফুড ডেলিভারি অ্যাপ। এটির মাধ্যমে মোবাইল পেমেন্ট করা যায়, গেমস খেলা যায়, সংবাদ থেকে শুরু করে ডেটিং – সব ব্যবস্থা আছে এই অ্যাপের মধ্যেই।এই একটি অ্যাপের মধ্যেই যেন হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, অ্যাপল পে, উবার, আমাজন, টিন্ডার এবং আরও বহু কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।চীনা সমাজের সবকিছুতে এই অ্যাপটি এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এটি ছাড়া সেখানে জীবন-যাপন করা যেন প্রায় অসম্ভব।নীচের ছবিতে যেমনটি দেখতে পাচ্ছেন, এই অ্যাপটির বিভিন্ন অংশের ইন্টারফেস একটির থেকে আরেকটি একেবারেই ভিন্ন।এটি শুরু হয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপ বা আইমেসেজের মতো একটি মেসেজিং অ্যাপ হিসেবে। এটির সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দুটি জিনিস হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপের মতো ‘চ্যাট’ এবং ফেসবুকের মতো ‘মোমেন্টস।’উইচ্যাটের ওয়ালেট চীনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, এটিকে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। চীনের বেশিরভাগ দোকান এবং অনলাইন কেনা-কাটায় উইচ্যাট পেমেন্ট নেয়া হয়। একটি কিউআর কোড স্ক্যান করে সহজেই পেমেন্ট করা যায়। লোকজন তাদের বাড়ির বিভিন্ন কিছুর বিল থেকে শুরু করে বিনিয়োগ, এমনটি অর্থ পর্যন্ত ধার করতে পারে উইচ্যাটের মাধ্যমে।সরকারি সেবাগুলোও সব উইচ্যাটে আছে। লোকজন তাদের সোশ্যাল সিকিউরিটি সংক্রান্ত তথ্য এই অ্যাপের মাধ্যমে দেখতে পারে। কেউ ড্রাইভিং এর গতি-সীমা লঙ্ঘন করে টিকেট খেলে সেটির জরিমানা পরিশোধ করতে পারে, এমনকি হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্টও বুক করতে পারে।
তবে একটিমাত্র অ্যাপের মধ্যে এতকিছু থাকার কিছু খারাপ দিকও আছে।বাস্তবতার নিরিখে দেখতে গেলে, উইচ্যাট অ্যাপটি এত বড় যে এটি ফোনের মেমোরির একটা বড় অংশ দখল করে রাখে। সাধারণত এই অ্যাপের জন্য দশ গিগাবাইট পর্যন্ত জায়গা লাগে।তবে আরও গুরুতর যেটি, সেটা হলো ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং নজরদারি নিয়ে উদ্বেগ। কারণ চীনা সমাজের সর্বক্ষেত্রে যেভাবে এই অ্যাপ ঢুকে পড়েছে তা সরকারী সেন্সরশিপ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে।চীনে অনেক বিদেশি ওয়েবসাইটে ঢোকার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিবিসির মতো সংবাদমাধ্যমে যেমন আছে, তেমনি ফেসবুক, এমনটি ইলন মাস্কের এক্স (টুইটার) পর্যন্ত রয়েছে।ইন্টারনেটে এই মাত্রার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের ফলে উইচ্যাটে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা লোকজনের জন্য খুবই বিপদজনক।যারা সরকারের বিরুদ্ধে কোন ধরণের ভিন্নমত প্রকাশ করেছে, তাদের একাউন্ট কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে- এটি অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়।বিতর্কিত কোন বিষয় নয়- এমন কিছু শেয়ার করার কারণেও অনেকে বিপদে পড়েছেন। তাদের একাউন্ট এবং চ্যাট গ্রুপ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।কিশ লিয়াও হচ্ছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের পরিচালক। তিনি বলেন, বেইজিং যেভাবে তাদের দেশের সবকিছু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, উইচ্যাটের মতো সুপার-অ্যাপ সেই কাজে বেশ সহায়ক।“এর মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ঝুঁকি কমানো- চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শাসনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বা এর বিরুদ্ধে বিরুদ্ধপক্ষকে সংগঠিত করতে পারে- সেরকম যে কোন কিছু প্রতিরোধ করাই মূল লক্ষ্য”, বলছেন তিনি।কিন্তু এরকম অ্যাপ কি পশ্চিমা দেশে কাজ করবে?
চীনে উইচ্যাটের বিরাট সাফল্যের পেছনে দুটি বড় বিষয় কাজ করেছে- বলছেন চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং এর কিচেং ফ্যাং।প্রথমত, চীনের বেশিরভাগ মানুষ উইচ্যাট ব্যবহার করে স্মার্টফোনের মাধ্যমে, ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকে নয়। কারণ চীনে ইন্টারনেটের প্রসার ঘটেছে একটু দেরিতে।
মি. ফ্যাং আরও বলেন, চীনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট ব্যবস্থা নেই, যা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় একদম উল্টো। চীনে উইচ্যাট তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্লাটফর্ম টাওবাও বা ভিডিও অ্যাপ ডোয়িনকে ব্লক করে দিতে পেরেছে, যেটি কোন পশ্চিমা দেশে সম্ভব নয়।কাজেই ইলন মাস্ক কি চীনের বাইরে একইরকমের একটি অ্যাপ তৈরি করতে পারবেন? সেটা হয়তো আমরা শীঘ্রই জানতে পারবো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটা হয়তো পুরোপুরি নির্ভর করবে ডিজিটাল পেমেন্টের ওপরনীতি-নির্ধারণী গবেষণা সংস্থা ট্রিভিয়াম চায়নার কেন্ড্রা শেফার বলছেন, চীনের প্রাত্যহিক জীবনে কিভাবে উইচ্যাট এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার কিছু বিষয় হয়তো ইলন মাস্ক অনুধাবন করতে পেরেছেন। এরমধ্যে একটি হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াকে ডিজিটাল পেমেন্টের সঙ্গে একীভূত করা।“এরকম একটি সুপার-অ্যাপের গোপন উপাদান হয়তো সেটাই”, বলছেন তিনি।বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান রেস ক্যাপিটালের এডিথ ইয়াং বলছেন চীনের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের বড় একটা পার্থক্য হচ্ছে চীনে যেভাবে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যাপকভাবে চালু হয়েছে।চীনের দোকানপাটে কেনাকাটার সময় নগদ অর্থে পরিশোধ করা হলে সেটি নিতে তারা যদিও আইনগত-ভাবে বাধ্য, বাস্তবে সেখানে ডিজিটাল পেমেন্টই এখন বেশি হচ্ছে।তিনি বলছেন, ইলন মাস্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষার পথে এটা হয়তো একটা বাধা। “নগদ টাকা বিহীন লেনদেন বা ক্রেডিট কার্ড ছাড়া একটা ব্যবস্থায় পৌঁছাতে পশ্চিমা দুনিয়ার হয়তো অনেক বেশি সময় লাগবে।”