বিশেষ বিবেচনায় এমপিও, বৈষম্যের শিকার এমপি-মন্ত্রীরা
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজ এলাকায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য ডিও (আধা সরকারিপত্র) লেটার দেন শতাধিক এমপি, মন্ত্রী ও সরকার দলীয় নেতা। শর্ত শিথিল করে প্রায় ৯১টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু নিজ নির্বাচনী এলাকায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একই ক্যাটাগরিতে এমপিওভুক্ত করিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি!
বিষয়টি জানাজানির পর ক্ষুব্ধ এমপিওভুক্তির প্রত্যাশায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। এমনকি বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন এমপিও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমপিও শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে জানান, অতি গোপনীয়তায় চাঁদপুর সদর উপজেলার ফরক্কাবাদ ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি স্তরকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি একই এলাকার চাঁদপুর সিটি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরকে এমপিওভুক্ত করা হয়। গত ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠান দুটির এমপিও ভুক্তির অর্ডার জারি করেন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মিজানুর রহমান। অর্ডারে প্রতিষ্ঠান দুটির যোগ্য শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত বিধি-বিধানের আলোকে সম্পন্ন করতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রভাব খাটিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকার দুটি কলেজ এমপিওভুক্ত করেছেন। এর আগে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের তদবিরে বিশেষ বিবেচনায় প্রায় একশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিতর্ক এড়াতে প্রধানমন্ত্রী সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। এরপরও শিক্ষামন্ত্রী নিজের নির্বাচনী এলাকার দুটি কলেজ এমপিওভুক্তি করায় নন-এমপিও শিক্ষকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কোন যোগ্যতায় চাঁদপুর সিটি কলেজকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দুটি কলেজ যে প্রক্রিয়ায় এমপিও হয়েছে এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নির্বাচনী এলাকায় হওয়ায় তিনি শিক্ষকদের দুর্দশা দেখেছেন। দুটি কলেজের সভাপতি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। দুজনের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কলেজ দুটি বিশেষভাবে এমপিও হয়েছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছর যখন এমপিও দেওয়া হয় তখন সকল যোগ্যতা অর্জন করতে না পারায় আমাদের কলেজটি বাদ পড়ে। শিক্ষকরা ১০-১২ বছর ধরে অমানবিক কষ্ট করেছেন। তাদের কষ্ট দেখে শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা সুজিত রায় নন্দী মিলে কলেজটি এমপিও করে দিয়েছেন।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের মধ্যে রয়েছে কাম্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর), পরীক্ষার্থীর সংখ্যা (৩০ নম্বর) এবং পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার (৪০ নম্বর)। তবে এ নীতিমালার ২২ ধারায় বিশেষ ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে এমপিওভুক্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি এলাকা, হাওর-বাওড়, চরাঞ্চল, ছিটমহল, বস্তি এলাকা, নারী শিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী (প্রতিবন্ধী, হরিজন, সেবক, চা-বাগান শ্রমিক, তৃতীয় লিঙ্গ ইত্যাদি) এবং বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, চারুকলা, বিকেএসপি, সংস্থা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় শর্ত শিথিলযোগ্য। কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করা এ দুটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নীতিমালার কোনো শর্তই মানা হয়নি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিতে আসা খুলনা অঞ্চলের একজন সংসদ সদস্য ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এলাকার শিক্ষকরা চাঁদপুরের এ দুটি প্রতিষ্ঠানের চিঠি দেখিয়ে বলছেন, স্যার অমুক প্রতিষ্ঠান হলে আপনারটার কেন হবে না? এটা জানতে আসলাম। কিন্তু মন্ত্রীকে (শিক্ষামন্ত্রী) পেলাম না। ওই প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অর্ডার স্বাক্ষর করেছেন উপ-সচিব মিজানুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু বিশেষ বিবেচনায় এমপিও দেওয়া হয়েছে, তাহলে বুঝতে হবে উপরের নির্দেশে হয়েছে। আমাদের কাজ হলো যে নির্দেশনা আসবে সেটি মেনে ফাইল পাঠানো। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে একাধিকবার গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি তার ব্যবহৃত সেলফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে গত বছরের ২১ জুলাই পর্যন্ত এমপিওভুক্ত করার জন্য অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়। তখন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীনে (স্কুল ও কলেজ) ৪ হাজার ৬২১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এর মধ্যে সকল সূচকে ১ হাজার ৯৪১টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে ২ হাজার ৫৪৪টি (মাদ্রাসা ও কারিগরি) প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছিল। এর মধ্যে মাত্র ২৯৫টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ও ৩৫৩টি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়। দফায় দফায় যাচাই করে গত বছরের ৬ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুই বিভাগের অধীনে ২ হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে। এমপিও নীতিমালা-২০২১ এর ১৬ ধারার চার উপধারা অনুযায়ী, বাদ পড়া ১ হাজার ৯১৬টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য আপিল করে। আপিল নিষ্পত্তি কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গত ১২ জানুয়ারি আরও ২৫৫টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শর্ত পূরণ না হওয়ায় সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিদের নির্বাচনী এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য গত নির্বাচনে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনের আগে এমপিওভুক্ত করা না হলে ভোটে প্রভাব পড়বে। এসব যুক্তি দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তদবির করেন তারা। ইতিবাচক সম্মতি পাওয়ার পর অনেক মন্ত্রী ও এমপি ডিও লেটারও দেন। প্রথমে এ সংখ্যা ছিল ৩৩টি। ধাপে ধাপে তা বেড়ে হয় ৯১টি হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে সম্মতি না দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ফাইল ফেরত পাঠান। এতে করে গত নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে শিক্ষামন্ত্রী নিজের প্রভাব কাটিয়ে নিজ নির্বাচনী এলাকার দুটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করায় অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বলেন, এমপিও নীতিমালা কঠোরভাবে মানার কারণে সারা দেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সাড়ে চার হাজার প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। হাজার হাজার উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সেখানে মন্ত্রীর নিজের এলাকার দুটি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা সারা দেশের নন-এমপিও শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল প্রতি বছর এমপিওভুক্ত করা। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে তা হচ্ছে না। বরং এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত গেছে। এ অবস্থায় বিশেষ বিবেচনায় এমপিও ঘোষণা নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতি অমানবিক আচরণ। সরকারের উচিত মানবিক হয়ে সকল স্বীকৃতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমপিওভুক্ত করতে অনেক সময় নানা ধরনের নির্দেশনা আমাদের কাছে আসে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে উপর থেকে নির্দেশনা ছিল। কখনও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, কখনও শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তর থেকে। তবে কোন পর্যায় থেকে নির্দেশনা ছিল ঠিক এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবে উপরের নির্দেশনা ছিল এতটুকু মনে পড়ছে।