শুক্রবার বিশ্ব ইজতেমার শুরু, বৃহস্পতিবারই ময়দান পূর্ন
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে তাবলীগ জামাতের বার্ষিক সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা। সাদপন্থি ও যুবায়েরপন্থিদের বিবদমান দ্বন্দ্বের কারণে এবারের বিশ্ব ইজতেমার মূল পর্ব দুইটি হলেও যুবায়েরপন্থিদের প্রথম পর্বটি দুইধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাদের প্রথম ধাপ ৩১শে জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে ২রা ফেব্রুয়ারি ও দ্বিতীয় ধাপ ৩রা ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ৫ই ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে যুবায়েরপন্থিদের দুই ধাপের ইজতেমা শেষ হবে। সাদপন্থিদের এক পর্বের ইজতেমা ১৪ই ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে ১৬ই ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে ২০২৫ সালের বিশ্ব ইজতেমা। ময়দানের সকল প্রস্তুতি কাজ প্রায় শেষ। তারপরও এখন চলছে চ’ড়ান্ত পর্যায়ের কিছু টুকিটাকি কাজ। ইতোমধ্যে টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের সিংহভাগই মুসুল্লীতে পূর্ণ হয়ে গেছে। মুসুল্লীরা নিজ নিজ খিত্তায় সু—শৃঙ্খলভাবে অবস্থান নিয়ে তছবিহ পাঠসহ ধর্মীয় কাজ কেও যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তারা শীর্ষ মুরুব্বীদের বয়ান শুরুর অপেক্ষা করছেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে সরজমিন টঙ্গী ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, ময়দানের উত্তর—পশ্চিম কোণে বিদেশি মেহমানদের থাকার জায়গা ও বয়ান মঞ্চের পূর্ব, উত্তর ও দক্ষিণ পাশের সামিয়ানা, শব্দ প্রতিধ্বনিরোধক বিশেষ ছাতা মাইক ও বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়েছে। কিন্তু ময়দানের উত্তর—পূর্ব কোণের ঢাকার খিত্তা ও ২৯নং টয়লেট বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ পাশ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ বেশ কিছু জায়গায় কোনো সামিয়ানা টাঙ্গানো হয়নি। তবে মুসল্লিদের অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত করতে ময়দানের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ব্রিজ থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত তুরাগ নদীতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের সদস্যরা ৫টি পন্টুন সেতু নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়াও ফেরি ঘাটের জেটি দিয়ে অপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করেছেন বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
ইজতেমা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ময়দানের চারপাশে পুলিশ ও র্্যাবের পক্ষ থেকে পর্যাপ্তসংখ্যক ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ময়দানের চারপাশের স্থাপিত বহুতল শৌচাগার ও পানি সরবরাহের লাইনগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও মেরামত করা হয়েছে।
এদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র সহকারী পরিচালক রেজওয়ান হাসান বলেন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের তুরাগ নদী পারাপারের জন্য ১টি পন্টুন সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে শুরায়ী নিজাম অনুসারি বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান সাংবাদিকদের জানান, ইজতেমা ময়দানের প্রায় ৯৭ ভাগ শেষ হয়েছে। মূল ময়দানে সামিয়ানা টাঙ্গানোর কাজ যতটুকু হয়েছে আপাতত ততটুকুই। বাকি সামিয়ানার স্থানীয় এবং আশে পাশের জেলার মুসুল্লীরা নিজ নিজ খিত্তায় ত্রিপল বা অন্যান্য চট/কাপড়ের সামিয়ানা টানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। বুধবারের বিকেল থেকেই নজমের জামাতের সাথীরা ময়দানে চলে এসেছেন এবং দেশ—বিদেশের মুসল্লিরা বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ময়দানে সমবেত হচ্ছেন।
প্রথম পর্বের যুবায়েরপন্থি মুরুব্বি প্রফেসর আব্দুস সালাম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের দুই পর্বের ইজতেমা প্রস্তুতি প্রায় শেষ। প্রথম পর্বের দুই ধাপ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমাদের অনুসারি তাবলীগ মুসুল্লীর সংখ্যা বেশি। মাঠে মুসুল্লীদের স্থান সংকুলান না হওয়ার কারণেই তারা প্রথম পর্বের ইজতেমাকে দুই ধাপে বিভক্ত করা হয়েছে। তাদের প্রথম পর্বের প্রথম ধাপ ৩১শে জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে ২রা ফেব্রুয়ারি ও দ্বিতীয় ধাপ ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ৫ই ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে।
গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিন সাংবাদিকদের জানান, ময়দানে আগত মুসল্লিদের আগমন ও স্থান সংকলন করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এবারের বিশ্ব ইজতেমাকে সামনে রেখে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরবর্তী সুবিশাল এলাকায় প্রায় ১৬০ একর জমির উপর তাবলীগ জামায়াতের সদস্যদের থাকার জন্য বিশাল চটের প্যান্ডেল তৈরি করা হচ্ছে। মাঠের উত্তর—পশ্চিম কোণে টিনের চালা দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে বিদেশি মেহমানদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা। আন্তর্জাতিক নিবাস বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন সংযোগসহ আধুনিক বিভিন্ন সুবিধাসমূহসহ সর্বাত্মক ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইজতেমার মাঠে আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে খাবার পানি, অজুখানা, পুরানো টিউবল, বাথরুম ও কাঁচা পাকা টয়লেট সংস্কার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে যাবতীয় সব কিছু সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য ইটের সলিং করার রাস্তা তৈরি ও পুরানো ভাঙাচোরা রাস্তা সংস্কার করা হয়েছে। বিদ্যুৎ লাইন, গ্যাস লাইন,পানির পাইপলাইন, পানির ট্যাংকি বসানোর সহ বাঁশের খুঁটি বসানো ও প্যান্ডেল সাজগোজের কাজ করা হচ্ছে। মুসল্লিদের যাতায়াতের কাজ যাতে কোনোরকম ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য তুরাগ নদীতে এবার সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং করে সদস্যরা ভাসমান সেতু নির্মাণ করেছেন। এদিকে বৃহস্পতিবার থেকে জামাতবদ্ধ মুসল্লিরা ইজতেমা মাঠে আসতে শুরু করেছেন। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ইজতেমা ময়দানের আয়োজক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজ জানান, ইজতেমা ময়দানের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। এবার ইজতেমায় বিশ্বের শতাধিক দেশের প্রায় ১০ থেকে ২০ হাজার বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করছেন আয়োজক কমিটি।
প্রথম ধাপে অংশগ্রহণ করছেন— গাজীপুর,টংগী,ধামরাই,গাইবান্ধা,মিরপুর,কাকরাইল,নাটোর,মৌলভীবাজার, রাজশাহী, দোহার,ডেমরা,কাকরাইল, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট,নবাবগঞ্জ, নীলফামারি, দিনাজপুর, রংপুর,বগুরা,নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা,চুয়াডাংগা,কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা,বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, শেরপুর, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ফেনী,লক্ষিপুর,চাদপুর,বি.বাড়িয়া,খুলনা,পটুয়াখালী, কুমিল্লা,ঝিনাইদহ, চাপাই নবাবগঞ্জ, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রাজবাড়ী জেলা। এই ধাপে ঢাকার একাংশ সহ মোট ৪১ টি জেলা অংশগ্রহণ করছে।
দ্বিতীয় ধাপে (৩ফেব্রুয়ারী থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি) অংশগ্রহণ করছেন অন্য জেলার মুসল্লিরা।
মাঠ এখন পুরাপুরি প্রস্তুত। মঙ্গলবার বিকাল থেকেই প্রথম ধাপে ইজতেমায় অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন খিত্তা ও পয়েন্টের জিম্মাদারগন আসা শুরু করবেন এবং বুধবার সকাল থেকে দেশী— বিদেশী মেহমান ও সাধারণ মুসল্লী আসা শুরু করেন।
দুই ধাপে ইজতেমা ইজতেমা করার কারণ হিসেবে হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান— তাবলীগের মেহনত একটি দ্বীনের অন্যতম মেহনত। এবং দ্বীনের ধারক বাহক হচ্ছেন হযরত ওলামায়ে কেরাম। ধর্ম প্রাণ মুসল্লী ভাইয়েরা উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে থেকেই তাবলীগের মেহনত করতে চান। এই সংখ্যাটা এত ব্যাপক যে টঙ্গী মাঠের ১৬০ একর জায়গায় তাদের অবস্থান করাটা খুবেই কষ্টদায়ক হয়ে যায়। গত কয়েক বছর শুরায়ী নেজামের অধীনে যে সকল ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়েছে, আপনারা জেনে থাকবেন আমাদের সাথীরা স্থায়ী টয়লেটের ছাদগুলোর উপরে, আশেপাশে ছোট ছোট মাঠগুলোর ভেতরে, এবং রাস্তায় ধুলাবালির ভিতর আমাদের সাথীরা কষ্ট করে অবস্থান করেছেন। এবার দুই ধাপে ইজতেমা হওয়ার কারণে তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে, ইনশাআল্লাহ।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার নাজমুল করিম খান জানান, ইজতেমা উপলক্ষে টঙ্গীও অঅশেপাশের এলাকা জুড়ে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার জন্য সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন বেশে ইজতেমা স্থলে অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। ইজতেমার শুরুর আগের দিন বৃহস্পতিবার থেকে পুলিশ, র্যাবসহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এজন্য ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ টঙ্গীতে আনা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ ও র্যাবের জন্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। স্থাপিত করা হয়েছে জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাবের কন্ট্রোল রুম। বিশ^ইজতেমা শুরুর দিন থেকেই হেলিকপ্টার আকাশপথে টহল থাকবে। মুসলিমদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে বিদেশী খিত্তাসহ বিভিন্ন পয়েন্টেপর্যাপ্ত সংখ্যক সরকারি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা: বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে স্টেশন রোডসহ ময়দানের চারপাশে সরকারি ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠণের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রায় অর্ধশত ফি্্র—মেডিকেল ক্যম্প স্থাপন করা হয়েছে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি ও হাতে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে টঙ্গী সরকারী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আফজাল হোসেন বলেন, টঙ্গী ২৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালকে ইজতেমার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও একটি হৃদরোগ ইউনিট, একটি বক্ষব্যাধি ইউনিট, এজমা ইউনিট, ট্রমা ইউনিট, অর্থোপেডিক ইউনিট ও বার্ন ইউনিট ১৫টি স্যানিটেশন টিম এবং ২৫টি এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের অপরাধ দক্ষিণের দায়িত্বে থাকা উপ—পুলিশ কমিশনার এনএম নাসিরউদ্দিন বলেন, ইজতেমা ময়দানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ পর্যায়ক্রমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ইজতেমা উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে।