ডেঙ্গু রুখতে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বাংলাদেশিদের রক্ত পরীক্ষার প্রস্তাব
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : বাংলাদেশ থেকে ডেঙ্গু জীবাণু নিয়ে কেউ সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন কী না, তার ওপরে নজর রাখতে সীমান্তের অভিবাসন কেন্দ্রগুলিতে ডেঙ্গুর রক্ত পরীক্ষা করার প্রস্তাব দিয়েছে কলকাতা কর্পোরেশন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত কেউ রাজ্যে আসছেন কী না, তা জানতে সীমান্তে রক্ত পরীক্ষার প্রস্তাবের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার পরে এবার পশ্চিমবঙ্গেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। গত ১২ দিনে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্ত তিন হাজারেরও বেশি। কলকাতার বাইরে, জেলাগুলিতেও খুব দ্রুত ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে বলে রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের সূত্রগুলি জানাচ্ছে।
কেন বাংলাদেশিদের রক্ত পরীক্ষা?
কলকাতার ডেপুটি মেয়র ও স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ বলছেন যে পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। আবার নিয়মিত বহু মানুষ বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসেন। তাদের মাধ্যমে যাতে কলকাতায় ডেঙ্গু সংক্রমণ না ছড়ায়, সেজন্যই সীমান্তে অভিবাসন কেন্দ্রে রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। মি. ঘোষ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “মানুষের শরীর ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক। কোন মানুষ হয়তো ডেঙ্গু নিয়ে এখানে আসছেন। এইরকম একটি লোককে যদি এখানকার এডিস মশা কামড়ায় – তাতে এখানকার আরও বেশ কিছু মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হবে। সেই কারণেই আমরা চাইছি যে অভিবাসন পয়েন্টে যেন রক্ত পরীক্ষা হয়। রাজ্য সরকারকে আমরা চিঠি দিয়ে অনুরোধ করব যেন তারা এ বিষয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে,“ জানাচ্ছিলেন অতীন ঘোষ। স্থল আর বিমান বন্দর – দুই জায়গাতেই বাংলাদেশিদের রক্ত পরীক্ষার প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. সায়ন চক্রবর্তী বলছিলেন যে এরকম একটা প্রস্তাবের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তার কথায়, “এটা তো কোভিডের মতো নতুন কোনও ভাইরাস নয় যে সীমান্তে পরীক্ষা করে সংক্রমণ আটকানো যাবে। বাংলাদেশে যেরকম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গু হচ্ছে, তাতে এটা সেকেন্ডারি ডেঙ্গু বলেই মনে হচ্ছে।” “সেখান থেকে ভাইরাস নিয়ে যদি কেউ এদিকে আসে, তাতে যে সিভিয়ার ডেঙ্গু ছড়াবে পশ্চিমবঙ্গে, তার কোনও মানে নেই। এখানকার ভাইরাস থেকেও দ্বিতীয়বার কারও ডেঙ্গু হতে পারে আর সেক্ষেত্রে সিভিয়ার হওয়ারই সম্ভাবনা থাকে।“
ডেঙ্গু রোগী আরও বাড়ার আশঙ্কা
ডাক্তার চক্রবর্তী কলকাতার যে হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে এখনও পর্যন্ত ‘সিভিয়ার’ ডেঙ্গু রোগী সেভাবে না এলেও চিকিৎসকরা আশঙ্কা করছেন যে রোগীর সংখ্যা, এবং ‘সিভিয়ার’ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে অদূর ভবিষ্যতে। তবে রাজ্যের সার্বিক ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। বুধবার স্বাস্থ্য দপ্তর ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে একটা বৈঠকও করেছে। ওই বৈঠকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনই পরিকাঠামোতে কোথায় খামতি রয়েছে, তাও খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দপ্তরের সূত্রগুলি জানাচ্ছে এখনও পর্যন্ত কলকাতা শহর ছাড়া উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, বাঁকুড়া আর নদীয়া – এই জেলাগুলি থেকেই বেশি ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এগুলির মধ্যে নদীয়া জেলাতেই সবথেকে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। ওই জেলায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জনের ডেঙ্গু হয়েছে। কলকাতা শহরে এখনও পর্যন্ত ১৯৭ জনের শরীরে ডেঙ্গু সংক্রম পাওয়া গেছে। সংখ্যাটা এখনও পর্যন্ত কম থাকলেও বর্ষার মরসুমে আরও অনেক মানুষের শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।
মশা থেকে বাঁচতেই হবে
ডাক্তার সায়ন চক্রবর্তী বলছিলেন, “প্রতিবছরই আমরা যেটা দেখি যে গোড়ার দিকে সংখ্যাটা কম থাকলেও ধীরে ধীরে সংক্রমিতের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। এবছরও সেরকমই হবে বলে আশঙ্কা করছি আমরা। “অন্যান্য বছরে যা দেখি আমরা, বহু মানুষের একবার করে ডেঙ্গু তো হয়ই, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলেই কেসটা ‘সিভিয়ার’ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে,” বলছিলেন ডা. চক্রবর্তী। এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মশা যাতে না জন্মাতে পারে, আর জন্মালেও তা যেন না কামড়ায়। ডা. চক্রবর্তীর কথায়, “মশারি টাঙানো একটা বড় সমাধান। আর তা না করতে পারলে মশা মারার যেসব তেল পাওয়া যায় অথবা আজকাল পোষাকে লাগানোর যে মলম পাওয়া যায়, সেগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে। “চিকিৎসকরা বারবার তাই বলছেন কদিনের জ্বর হলেই ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়ার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা দরকার। বেশি দিন জ্বর ফেলে রাখলে তা ‘সিভিয়ার’ হয়ে উঠতে পারে বলেও সতর্ক করছেন চিকিৎসকরা।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচীতে জোর পুর প্রশাসনের
এর আগে, ২০১৯ সালে কলকাতা কর্পোরেশন প্রস্তাব দিয়েছিল ডেঙ্গু দমনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত তারা। কলকাতা পুর প্রশাসন বলছে তারা বছরভর ডেঙ্গু প্রতিরোধ কর্মসূচী চালালেও বর্ষার আগে থেকেই তারা ডেঙ্গু-রোধ কার্যক্রমে জোর দিচ্ছে। কলকাতা কর্পোরেশনের অন্যতম বড় ওয়ার্ড, দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক অঞ্চলের ৯৩ নম্বর ওয়ার্ডটি। সেখানকার পুর-প্রতিনিধি মৌসুমী দাস জানাচ্ছেন বছরের অন্যান্য সময়ে সপ্তাহে দুদিন করে ডেঙ্গু মোকাবিলার কাজ হয়, কিন্তু বর্ষার মরসুম শুরু হতে প্রতিদিনই তার এলাকায় এই কাজ করছেন তারা। “এটাকে আমাদের পরিভাষায় যৌথ কর্মসূচী বলি, যেখানে পৌরসভার সব সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীরা, আমি নিজে – সবাই মিলে একটা এলাকা নির্দিষ্ট করে জমা জল পরিষ্কার করি, আবর্জনা পরিষ্কার করি, মশা মারার তেল আর ব্লিচিং পাউডার ছড়াই। ওই এলাকায় সচেতনতা, প্রচারও চলতে থাকে,” জানাচ্ছিলেন মিসেস দাস। তবে যেসব বাড়ি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে, সেখানে জল জমেও ডেঙ্গু ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। পুলিশের সহায়তা নিয়ে তালা ভেঙ্গে ওইসব বাড়িতে ঢুকে জমে থাকা জল পরিষ্কার করে আবার তালা বন্ধ করে দিচ্ছে পুলিশ। একই সঙ্গে বহুতল ভবনগুলির ছাদে বা অন্য কোথাও জল জমে থাকছে কী না, তা দেখার জন্য ড্রোন ব্যবহার করা হয়।