আর্থিক সেবার গ্রাহকের তথ্য বিক্রির ভুয়া ব্যবসা
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বিক্রির পর ডিজিটাল স্পেসে গ্রাহকদের ঠকানোর নতুন কৌশল হিসেবে হাজির হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকের ভুয়া তথ্য বিক্রি করার বিজ্ঞাপন। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়সহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের নামও ব্যবহার করা হচ্ছে। টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে দেশের মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য ঘুরছিল ২০২৩ সাল থেকেই। এসব তথ্য কেনাবেচার কথাও শোনা গেছে। গ্রাহক তথ্য বিক্রির ক্ষেত্রে নতুন একটি ভুয়া ব্যবসা শুরু করেছে একটি চক্র। শুরুর দিকে মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামের বিশেষ সফটওয়্যারের (বট) মাধ্যমে কাজটি করা হয়েছে। তবে এখন বটের পাশাপাশি ওয়েব সাইট খুলেও ভুয়া তথ্যের জমজমাট এই ব্যবসা চলছে। চক্রটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে তাদের দেওয়া বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি তারা বেশ কিছু নামিদামি ব্যাংকের গ্রাহকের তথ্য রয়েছে বলেও প্রচার চালাচ্ছে। নিত্যনতুন কৌশলে তারা একের পর এক গ্রাহক ধোঁকা দেওয়ার এই ব্যবসা করে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বেহাত হওয়ার পর যেভাবে টেলিগ্রাম চ্যানেলের প্রচার হওয়া নির্দিষ্ট একটি লিংকে ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর ও জন্মতারিখ দিলেই যেভাবে তার অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য বেরিয়ে আসছিল– একইভাবে এখানেও কিছু মানুষের তথ্য বেরিয়ে আসছে। তবে যে তথ্য এখানে পাওয়া যাচ্ছে তার সত্যতা নিরূপণ করার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেকেই ভূঁইফোঁড় ব্যবসা বলেও আখ্যায়িত করছেন। বেশ কিছু ওয়েব সাইটে দেখা গেছে, মোবাইল নম্বর দিলে আবার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর বা নাম– এমন কিছু তথ্য আসছে। সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রথম রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন থেকে লক্ষ্যাধিক মানুষের তথ্য ফাঁসের ঘটনা ঘটে। তারও কয়েক মাস পর জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য চুরির তথ্য সামনে আছে। এখন এসব তথ্যকেই নতুন মোড়কে মোবাইল ব্যাংকিং এবং প্রচলিত ব্যাংকের গ্রাহক তথ্য হিসেবে হাজির করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে তথ্যগুলো যাচাই বাছাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, একেকটা গ্রুপে একেক রকম তথ্য আসছে। কোথাও গ্রাহকের সঙ্গে সঙ্গে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর আছে বলে বলা হচ্ছে। আবার কোথাও মোবাইল নম্বর, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং জন্ম তারিখের উল্লেখ থাকছে। তাছাড়া কোথাও কোথাও ছবি থাকার দাবিও করা হচ্ছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা জানান, এ ধরনের তথ্য যারা অনলাইনে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি করছে, এবং প্রলোভনে পড়ে যারা কিনছে উভয়েই সমান অপরাধী। বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ ও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া উভয়েই জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে বলেও জানান তিনি। দেশে ইথিক্যাল হ্যাকিং নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অক্টাগ্রাম লিমিটেডকে এ বিষয়ে কাজ করার জন্যে সম্প্রতি ডেকেছিল দুটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষ্মা বাহিনী। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হাসান শাহরিয়ার বলেন, মূলত অনেকেই প্রলোভনে পড়ে এমন তথ্য কিনে থাকেন। তবে যারা তথ্য বিক্রি করেন তারা এটি করার সময় ক্রেতার গ্রাহকের তথ্যটাও সংরক্ষণ করেন। যেহেতু ক্রয়কারীর তথ্য সংরক্ষণ করছেন, ফলে ভবিষ্যতে গ্রাহক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন হ্যাকিং, ব্ল্যাক মেইলসহ নানা জটিলতায়। তখন কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গিয়ে তারা বলতেও পারবেন না কেন এবং কী কারণে তিনি অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। তবে গ্রাহকদের তথ্য এভাবে অবাধে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ানোর দাবি করায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের অনাস্থা তৈরি হওয়া বা অহেতু ভীতসন্ত্রস্ত্র করে ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি করছে।
সাম্প্রতিক সময়ের এই প্রচারণা মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর দৃষ্টিতেও এসেছে। তারা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও – বিষয়টি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে আমরা প্রতিনিয়তই তথ্যগত নানান অপপ্রচারের শিকার হাই। এবারকার বিষয়ও আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আমরা এটি অবহিত করেছি।
তবে তথ্য প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেজ থেকে তথ্য বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা এর আগে ঘটেছে বলে এমনিতেই মানুষ এ নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। এখন তাদেরকে বিভ্রান্ত করাটা আগের চেয়ে সহজ। ফলে সত্য-মিথ্যা নানান রকম কথা বলে সুযোগ সন্ধানী কেউ কেউ ব্যবসা করে থাকতে পারে। তিনি বলেন, বর্তমানে যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ও ছবি লাগে। তবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে যে তথ্য ঘুরছে বলে বলা হচ্ছে এসব তথ্য সত্য হলেও এ দিয়ে কিছুই করা যাবে না বলেও মনে করিয়ে দেন ওই প্রযুক্তিবিদ। বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র ডেটাবেজে ১২ কোটির মতো মানুষের তথ্য রয়েছে। অন্যদিকে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক আছে ২১ কোটির বেশি।