ঋণ পরিশোধ নিয়ে সংকট
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক :ঋণ পরিশোধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। করোনা মহামারির পর বড় ধাক্কা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আমদানি, পরিবহন ও জ্বালানি ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে। মুখ থুবড়ে পড়তে পারে ব্যাংকিং খাত। রাজস্ববঞ্চিত হবে সরকার। পরিস্থিতি উত্তরণে ঋণ আদায় এবং রাজস্ব বাড়ানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ ছিল ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের ৮ দশমিক ৮০ শতাংশই খেলাপি। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ পরিশোধ নিয়ে গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যখন এলসি বা ঋণপত্র খুলেছেন, তখন প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা। সেই এলসির দায় এখন ১০৮ টাকা প্রতি ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। করোনা মহামারিও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামাল আমদানি, পরিবহন, জ্বালানি ব্যয় বৃদ্ধিতে নাস্তানাবুদ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সংকট মোকাবিলায় অসহায় হয়ে পড়েছেন।বিশ্লেষকরা বলছেন, ঋণ বেড়ে যাচ্ছে এটা বিষয় না। এসব ঋণ সুষ্ঠুভাবে পরিশোধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে। প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি অথবা উপদেষ্টা পর্ষদ গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি উপদেশ বা পরামর্শ দেবে কোন ঋণ আগে পরিশোধ করা জরুরি। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধের শর্তাবলিও ঠিক করে দেবে কমিটি। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে গ্রাহক বা ব্যাংক যাতে বিপাকে না পড়ে সেজন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং বৃহৎ ঋণ বীমার আওতায় আনতে হবে। ঋণবীমা নিতে উৎসাহিত করতে ঋণের সুদ কম নেওয়া যেতে পারে। কারণ ঋণের ঝুঁকি কমলে রিস্ক প্রিমিয়াম কমে আসে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চাপ প্রয়োগ করে নয়, ঋণ পরিশোধে ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিতে হবে। পরিশোধের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এজন্য খাতসংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের নিয়ে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি টার্মস অব রেফারেন্স তৈরি করবে এবং সে অনুযায়ী প্রতি মাসে মিটিং করে অর্থমন্ত্রীকে অবগত করবে। এখন এ ধরনের কোনো কমিটি না থাকায় ঋণ আদায়ে শৃঙ্খলা নেই। কমিটি ঋণ আদায় কার্যক্রম সময়ে সময়ে রিভিউ করবে। পরামর্শগুলো অর্থমন্ত্রীকে জানাবে, সরকার সেটা বাস্তবায়ন করবে।জনতা ব্যাংকের সাবেক এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, পেশাদার অর্থনীতিবিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সাবেক ব্যাংকার, আইনজীবী, এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, এমসিসিআই, এবিবি প্রতিনিধি নিয়ে আট থেকে নয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ঋণ পরিশোধে এ মুহূর্তে কোনো ছাড় নেই ব্যবসায়ীদের জন্য। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পঋণ, কৃষিঋণ ও সিএমএসএমই ঋণ পরিশোধে ছাড় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে এ সুবিধা তুলে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সব চলতি মূলধন ও মেয়াদি ঋণের ৫০ শতাংশ পরিশোধে খেলাপি হবে না বলে বিশেষ ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জুলাই থেকে ঋণ পরিশোধে কোনো বিশেষ সুবিধা নেই ব্যবসায়ীদের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের কারণে ভালো ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ছেন। ভালো ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধে অগ্রাধিকার নির্ধারণের প্রয়োজনে সরকার একটি কমিটি গঠন করে দিতে পারে। সেই কমিটি নির্ধারণ করে দেবে কোন ঋণ আগে পরিশোধ করা দরকার। কমিটি গঠনের পাশাপাশি ঋণ বিতরণকারী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কার্যকর উদ্যোগ থাকতে হবে।গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তবে সেখানে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকলে ভালো ফল পাওয়া যাবে না। সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানির আদলে একটি স্বতন্ত্র কমিটি গঠন করা গেলে খেলাপি ঋণ আদায়ে সুফল মিলতে পারে।এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার শর্তানুসারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণকে ক্লাসিফায়েড হিসেবে তালিকাভুক্ত করার জন্য ওভারডিউ পিরিয়ড ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করার পরিকল্পনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ গোপন করার প্রবণতা বাড়বে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ব্যাংকগুলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ গোপন রেখেছে।এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের শর্তানুযায়ী এমন পদক্ষেপ নিতে পারে, তবে এটি ক্লাসিফায়েড ঋণের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেবে। দেশের সিংহভাগ ঋণই মেয়াদি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এর মধ্যে তিন মাস পর ঋণ ক্লাসিফায়েড করা হলে খেলাপি ঋণ ব্যাপক বেড়ে যাবে।