মণিপুরের সেই দুই নারীর সঙ্গে কী হয়েছিল? প্রকাশ্যে নতুন তথ্য
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : প্রায় ছয় মাস আগে ভারতের মণিপুরে জাতিগত সহিংসতায় পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দুই নারী। ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ক্ষোভে ফেটে পরেন ভারতীয়রা। প্রতিবাদে উত্তাল হয় দেশটি। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত-বিচারে ও সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ আসে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত থেকে। এছাড়া কথা বলতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েছিল ভারত সরকার।
জাতিগত সহিংসতার জেরে মণিপুরে দুজন নারীকে বিবস্ত্র করে ঘুরিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ ওঠেছিল। পাশবিক ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে বিশ্বের দৃষ্টি যায় রাজ্যটির দিকে। যদিও ঘটনার ভিডিও প্রকাশ্যে এলে নিজেদের আড়াল করেন দুই নারী। তবে সম্প্রতি সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন তারা। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে জানিয়েছেন সেই পৈশাচিক নির্যাতনের কথা। বলেছেন, আমরা আদিবাসি নারীরা খুব শক্ত। আমরা হাল ছেড়ে দেব না। এছাড়া প্রকাশ্যে এসেছে জাতিগত সহিংসতার নেপথ্যের আরো নির্মম সত্য।
কী হয়েছিল দুই নারীর সঙ্গে?
কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের দুই নারী গ্লোরি (ছদ্মনাম) ও মার্সি (ছদ্মনাম) এই প্রথম রাজি হন কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে দেখা করতে। যেন নিজেদের কষ্ট আর ন্যায়বিচারের জন্য লড়াইয়ের কথা তারা সারা বিশ্বের কাছে জানাতে পারেন। অদৃশ্য হতে গিয়েও আজ তাদের কণ্ঠস্বর দৃঢ়। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওটা দেখা খুব পীড়াদায়ক। প্রায় এক-মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মেইতেই সম্প্রদায়ের পুরুষরা দুজন বিবস্ত্র নারীকে ঘিরে রেখেছে, ধাক্কা দিচ্ছে, জোর করে গোপনাঙ্গ স্পর্শ করছে এবং মাঠে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তাদের দলবেঁধে করা হয়েছে বলে ওই দুই নারী অভিযোগ করেছেন। সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে গ্লোরির গলা ধরে আসে। ভুক্তভোগী গ্লোরি বলেন, আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়েছিল। ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর বেঁচে থাকা এমনিই কঠিন ছিল। দুমাস পরে যখন ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়, তখন বাঁচার ইচ্ছেটাও চলে যেতে লাগল। আমি সব সম্প্রদায়ের মায়েদের বলতে চাই, যাই ঘটুক না কেন, তারা যেন সন্তানদের শেখান- কোনও পরিস্থিতিতেই নারীদের বেইজ্জত না করে।ভুক্তভোগী নারী মার্সি বলেন, ভারতীয় সমাজে এরকম একটা ঘটনার পর নারীদের কোন নজরে দেখা হয় সবাই জানে। এখন আমি আমার সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গেও চোখ মেলাতে পারি না। আমার ইজ্জত চলে গেছে। আমি আর কখনও আগের মতো হতে পারব না। এদিকে ওই ভাইরাল ভিডিওটি এই নারীর যন্ত্রণা বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেও, সেটি এমন একটি প্রমাণ সামনে এনেছে, যা মেইতেই আর কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলা জাতিগত সহিংসতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এদিকে পাশবিক এই হামলার আগে গ্লোরি যে কলেজের ছাত্রী ছিলেন, সেখানে মেইতেই ও কুকি দুই সম্প্রদায়ের ছাত্রছাত্রীরাই পড়তেন। আর মার্সির দিন কাটত তার দুই সন্তানের দেখাশোনা করে, তাদের লেখাপড়া করানো ও গির্জায় গিয়ে। ওই ঘটনার পর এখন এই দুই নারীকে গ্রাম ছেড়ে অন্য শহরে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। ভয় আর লজ্জায় তারা এখন কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন। মার্সি এখন গির্জা বা স্কুলে যান না। এক আত্মীয় তার সন্তানদের নিয়ে যায় আর নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, রাতে অনেক কষ্টে ঘুম আসে আর দুঃস্বপ্ন দেখি। ঘর থেকে বের হতে পারি না। মানুষের সঙ্গে দেখা করতে ভয় পাই, লজ্জাও লাগে। ওই ঘটনার পর দুজনেই কুঁকড়ে গিয়েছেন। কাউন্সেলিং সাহায্য করলেও, ঘৃণা ও ক্রোধ জমে আছে তাদের মনে।
মণিপুরে জাতিগত সহিংসতার নেপথ্যে
এ রাজ্যে মোট জনসংখ্যা ৩৩ লাখ, তার অর্ধেকেরও বেশি মেইতেই সম্প্রদায়ের আর ৪৩ শতাংশ কুকি-নাগা সম্প্রদায়ের। গত মে মাসে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয় যখন মেইতেই সম্প্রদায়ের তফসিলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবির বিরোধিতা করে কুকি সম্প্রদায়। তাদের আশঙ্কা ছিল এর ফলে কুকি এলাকায় জমি কিনে মেইতেই সম্প্রদায় আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠবে।
মুখ্যমন্ত্রীর বিতর্কিত ভূমিকা
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং, যিনি মেইতেই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তিনি সাম্প্রদায়িক উসকানির জন্য দায়ী করেছেন চরমপন্থী কুকি গোষ্ঠীগুলোকে। এ সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ২০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই কুকি সম্প্রদায়ের। উভয় সম্প্রদায়ের হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সহিংসতা যেভাবে ছড়াল
মে মাসে মণিপুরে শুরু হওয়া জাতিগত সহিংসতায় যে গ্রামগুলো প্রথম আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে গ্লোরি আর মার্সির গ্রামও ছিল। ওই সংঘর্ষে গ্লোরি তার বাবা ও ভাইকেও হারিয়েছেন। আমরা আদিবাসি নারীরা খুব শক্ত। আমরা হাল ছেড়ে দেব না।তিনি বলেন, আমি তাদের আমার চোখের সামনে বাবা-ভাইকে মরতে দেখেছি। প্রাণ বাঁচাতে বাবা আর ভাইয়ের দেহ মাঠে ফেলে রেখেই দৌড়তে হয়েছিল। এখন গ্লোরি তার মেইতেই বন্ধু বা সহপাঠীদের সঙ্গে পড়া তো দূর, ওই সম্প্রদায়ের কারও মুখও দেখতে চান না।তিনি বলেন, আমি আর কখনও আমার গ্রামে ফিরে যাব না। আমার বাড়ি ওখানে, আমি বেড়েও উঠেছি সেখানে। কিন্তু ওখানে থাকার অর্থ আশেপাশের গ্রামের মেইতেই লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করা, যেটা অসম্ভব। মার্সিও একই কথা বিশ্বাস করেন। আমি তো ভাষাটাই শুনতে চাই না। এদিকে সহিংস আক্রমণের ঘটনার পর মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায় একে অন্যের এলাকায় পা রাখতে পারেন না। বর্তমানে মণিপুর দুটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও দুই সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরি চেক-পয়েন্ট রয়েছে। অপরদিকে মার্সির স্বামী জানান, হামলার দুসপ্তাহ পরেই তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, তবে ভিডিওটি প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুলিশ বিবিসিকে জানিয়েছে, ওই ঘটনায়, ভারপ্রাপ্ত অফিসার-সহ মোট পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ওই ঘটনায় মণিপুর পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। মার্সির স্বামী বলেন, ভিডিও ছাড়া কেউ আসলে সত্যিটা বিশ্বাস করত না, আমাদের কষ্টটা বুঝত না। মার্সির এখনও দুঃস্বপ্ন দেখেন। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভয় পান। গ্লোরি বলেন, ওই অঞ্চলে দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক প্রশাসনই হতে পারে নিরাপদে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়। এই দাবিটি কুকি সম্প্রদায় একাধিকবার উত্থাপন করেছে কিন্তু মেইতেই সম্প্রদায় তার বিরোধিতা করেছে। দুপক্ষেরই নিজস্ব যুক্তি আছে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংও এই বিভাজনের বিরোধী। বিরোধী দলগুলো বারবার মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে, তবে রাজ্য সরকার বৈষম্যের সমস্ত অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এই অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে জানতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলতে রাজি হননি। অপরদিকে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে সহিংসতায় নিহতদের চিহ্নিত করে মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছে। এ নিয়ে গ্লোরি এখনো তার আশা জিইয়ে রেখেছেন। তিনি ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী। গ্লোরি ভবিষ্যতে অন্য কলেজে পড়াশোনা শুরু করে পুলিশ বা সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে চান। আমি যে কোনো মূল্যে ন্যায়বিচার চাই। আজ আমি এই জন্যই কথা বলছি যাতে আমার মতো অন্য কোনও নারীকে এ জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়। মার্সি বলেন, আমরা আদিবাসি নারীরা খুব শক্ত। আমরা হাল ছেড়ে দেব না। আমি সব সম্প্রদায়ের মায়েদের বলতে চাই, যাই ঘটুক না কেন, তারা যেন সন্তানদের শেখান- কোনও পরিস্থিতিতেই নারীদের বেইজ্জত না করে।