বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, রেজি নং-৩৬)

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে মন্ত্রণালয়

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে মন্ত্রণালয়

মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরুতে ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে ১ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮০ জন। শুধু তাই নয় ২০১২ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে সাড়ে ১২ বছরে ৩৭ হাজার ৭৩১ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন করে গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।

অভিযোগ রয়েছে, বিগত সময়ে যাচাই-বাছাই না করে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে গেজেটভুক্ত করা হয়েছে। এই সুযোগে তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন বাগিয়ে নিয়েছেন চাকরি। অনেকে হয়েছেন ক্ষমতাবান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই তালিকায় কাটছাঁট করে স্বচ্ছ একটি তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, বীরপ্রতীক তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে কতজন সরকারি চাকরিতে আছেন তাদের তালিকাও তৈরি করতে বলেছেন। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও জামুকা।

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় ও জামুকা সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও অধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বীরপ্রতীক। সেই বৈঠকে বিগত সময়ে জারি হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট পর্যালোচনা করে সেখান থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার জোরালো নির্দেশ এবং ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলেন তিনি।

জামুকার কমিটি হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই

নতুন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির আবেদন যাচাই-বাছাই, গেজেটপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য সংশোধন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তা তদন্ত ও নিষ্পত্তি ইত্যাদি কাজ করে জামুকা। এই কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তিন বছর পরপরই একটি বোর্ড গঠন করে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভেঙে দেওয়া হয় জামুকার কমিটি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জামুকার বোর্ড পুনর্গঠনের প্রস্তাব পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। তবে এখনও সেই কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কমিটি অনুমোদন পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাই করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা এই মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বেও নিয়োজিত রয়েছেন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় তিনি সেদিকে ব্যস্ত রয়েছেন। আশা করা হচ্ছে কয়েকদিনের মধ্যে জামুকার বোর্ড গঠন করা হবে।

কোন পদ্ধতিতে যাচাই-বাছাই হবে তা ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইলে জামুকার এক কর্মকর্তা বলেন, এখনও পুরোপুরি চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমরা কিছু পরিকল্পনা করেছি। যেমনÑ বিগত সরকারের মেয়াদে যেসব মুক্তিযোদ্ধা সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের তথ্যগুলো আবার যাচাই করা হবে। কোনো মুক্তিযোদ্ধার ব্যাপারে অভিযোগ থাকলে তা জানানোর জন্য গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হতে পারে। সেই গণবিজ্ঞপ্তিতে আসা অভিযুক্তদের তথ্য যাচাই করা হবে। এজন্য জেলা-উপজেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আলাদা কমিটি করা হতে পারে। যাচাইয়ে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে প্রমাণিত হবে তাদের ভাতার প্রাপ্ত টাকা সুদে আসলে ফেরত আনাসহ আইনি শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।

মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিপ্রাপ্তদের তথ্য সংগ্রহ চলছে

এদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবহার করে স্বাধীনতার পর থেকে গ্রেড অনুযায়ী কতজন সরকারি চাকরি পেয়েছেন তার তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। পরে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে সেই তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সব মন্ত্রণালয়ের কাছে নির্ধারিত ছকে তথ্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।

ছকে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির নাম, পদবি ও শ্রেণি উল্লেখ করতে বলা হয়েছে; বাবার নাম ও পুরো ঠিকানা; যার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বা গেজেটের পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগ পেয়েছেন তার নাম ও ঠিকানা; মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট নম্বর এবং কত তারিখে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তার তথ্যও জানাতে বলা হয়েছে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, তালিকা চেয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছি। তারা তালিকা তৈরির কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই এই তালিকা চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠাব।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এবারের যাচাই-বাছাইয়ে যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত হবেন তাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে কোটায় চাকরি নিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সার্বিক বিষয়ে জামুকার ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. রুবাইয়াত শামীম চৌধুরী বলেন, জামুকার বোর্ড গঠন হলেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পর্যালোচনা শুরু করব। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা যারা প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী বলেন, আমি শুনেছি তারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি তালিকা থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিতে পারেন তাহলে এটা খুবই ভালো কাজ হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধন্যবাদ জানাবেন।

সব সরকারের আমলেই বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা

স্বাধীনতার পর বিগত সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় কাটছাঁট হয়েছে। দফায় দফায় পাল্টানো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার আমলেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে প্রণয়ন করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকাভুক্ত করে। এটি লাল তালিকা বা লাল বই নামে পরিচিত। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে স্থানীয় পর্যায় থেকে যাচাই-বাছাই শেষে ১ লাখ ৯৮ হাজার জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে। আগের সরকার থেকে বিএনপির আমলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ে ৪৪ হাজার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে বিএনপি সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে। এরপর আওয়ামী লীগ প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের টানা প্রায় ১৬ বছরের ক্ষমতাকালে তাদের মন্ত্রী-এমপিসহ অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারাও গেজেটপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। সমালোচানার পর অনেককে বাদও দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ১০ বছর থাকা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও সাবেক বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ফারুক খানের নামে গেজেট জারির পর সমালোচনার মুখে তা আবারও যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ

বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন