কিন্ডারগার্টেনকে নিবন্ধনের আওতায় আনতে গঠন হচ্ছে অধিদপ্তর


মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : দেশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলকে নিবন্ধন ও শিক্ষাবিষয়ক (একাডেমিক) স্বীকৃতির আওতায় আনতে চায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে গঠন হচ্ছে স্বতন্ত্র অধিদপ্তর।
জানা যায়, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে এক লাখের বেশি। এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজার ৫৬৬টি। অন্যগুলো কিন্ডারগার্টেনসহ বেসরকারি বিদ্যালয়। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশের নিবন্ধন নেই। ইচ্ছেমতো তারা চলছে। আগে একটি বিধিমালা থাকলেও সেটি বাস্তবে কাজে দেয়নি।
এখন সেটিকে আরও যুগোপযোগী করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ লক্ষ্যে বর্তমান বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের কাজের পরিধি বাড়িয়ে এবং জনবল কাঠামোতেও পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করে ইউনিটের দাপ্তরিক স্ট্যাটাস নির্ধারণ করে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি অধিদপ্তর গঠনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে একাধিক সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৯ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানার সভাপতিত্বে মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় পৃথক এই অধিদপ্তর গঠনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরই কার্যক্রম শুরু করবে নবগঠিত এই অধিদপ্তর।
এ দিকে বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার গোড়াপত্তনেই নানা ধরনের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু জরিপেও এই দুর্বলতার দিকটি উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশুদের শিক্ষার গোড়াপত্তনের ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। এখানেই গলদ ধরা পড়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ক্লাসে কী শিখছে তার একটি জরিপেই উঠে এসেছে দুর্বলতার অনেক দিক। গত কয়েক মাস আগে বিদ্যালয়গুলোর পড়ালেখার মানের দিক দিয়ে শ্রেণিবিভাজনের কাজও শুরু করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পরিবর্তন করে সেখানে ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টের (এনএসএ) আদলে মৌলিক দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে প্রতিটি বিদ্যালয়কে মান অনুযায়ী সবুজ, হলুদ ও লাল ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই দুর্বলতা কাটিয়ে কিভাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে সবল করা যায় তার সুর্নিদিষ্ট কিছু সুপারিশও নির্ধারণ করা হয়েছে। এ রকম ১৪টি সুপারিশের কথা জানিয়েছেন প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কার পরামর্শ কমিটির আহ্বায়ক ড. মনজুর আহমদ।
সূত্রমতে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অধিদফতরে রূপান্তর করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা সভায় উপস্থাপিত একাধিক প্রস্তাবনার ওপর আলোচনা করেন। সভায় উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা বিদ্যমান বিধিবিধান ও বাস্তবতা বিবেচনায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটকে একটি শক্তিশালী মনিটরিং ইউনিটে রূপান্তর করার লক্ষ্যে তিনটি প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করেন। তবে সভায় সর্বসম্মতির ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ
সুপারিশকৃত কার্যাবলির পাশাপাশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন ও হাইস্কুলসংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিবন্ধন কার্যক্রম এবং নিবন্ধনের শর্তাবলি প্রতিপালনের কার্যক্রম পরিবীক্ষণসংক্রান্ত কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে মতামত দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ ইউনিটের’ নাম পরিবর্তন করে ‘প্রাথমিক শিক্ষা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অধিদপ্তর’ নামে নামকরণ করা হবে।
নবগঠিত এই অধিদপ্তর তাদের কার্যক্রম শুরু করলে সুনির্দিষ্ট ১৭টি কাজের বা দায়িত্বের বিষয়েও সভায় আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান ও অন্যতম কাজ হবে প্রাথমিক শিক্ষার মান পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও গবেষণা এবং এর আলোকে সুপারিশ প্রণয়ন করা। এ জন্য জেলা বিভাগ এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন করা। এ ছাড়াও নতুন এই অধিদফরের মূল কাজ হবে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেনগুলোর নিবন্ধন কার্যক্রম মনিটরিং ও নিবন্ধন শর্তাবলি প্রতিপালন নিশ্চিত করা। একই সাথে নিবন্ধনকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত লার্নিং সেন্টার (এনজিওয়ের মাধ্যমে পরিচালিত সেন্টারসহ) শিশু কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত বিদ্যালয় ও কমিউনিটি বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন ও তদারকি করা। সর্বোপরি প্রাথমিক শিক্ষাসংক্রান্ত তথ্য ও বক্তব্য প্রচার করবে এই অধিদফতর।
যদিও বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন বিভাগের কয়েকটি জেলা ও উপজেলায় প্রাথমিক শিক্ষার মাঠপর্যায়ের চিত্র তুলে আনতে একাধিক মনিটরিং টিম কাজ করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পরিচালিত এই পরিদর্শনে প্রাথমিক শিক্ষার মান কতটুকু তলানিতে রয়েছে তার একটি বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। শিক্ষার্থীদের শিখন মান বাদক্ষতা অর্জনের বিবেচনায় ০০ থেকে ৬০ শতাংশ হলে লাল, ৬১ থেকে ৭৯ শতাংশ হলে হলুদ এবং ৮১ থেকে ১০০ শতাংশ হলে সবুজ ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিখন মান যাচাইয়ে দেশব্যাপী যে পরিদর্শন কার্যক্রম চলমান রয়েছে তার একটি সারসংক্ষেপ সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষার নানা ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েছে। এই পরিদর্শন বা জরিপ কাজে তিনটি ক্যাটাগরিতে বিদ্যালয়গুলোকে ভাগ করা হয়েছে। লিখতে, পড়তে ও বুঝতে পারার দক্ষতা যাচাইয়ে শিক্ষার্থীদের তথা বিদ্যালয়গুলোকে তিনটি ভাগ করা হয়েছে। সেখানে লাল, হলুদ ও সবুজ এই তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ হয়। সূত্রমতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ইউনিটের মাধ্যমে পরিচালিত জরিপে ঢাকা মহানগরীর তিনটি থানায় (মতিঝিল, রমনা, ধানমন্ডি) ২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে দেখা গেছে কোনো একটি বিদ্যালয়ও সবুজ ক্যাটাগরিতে স্থান পায়নি। এমনকি হলুদে পড়েছে মাত্র ছয়টি বিদ্যালয়। বাকি ১৫টি বিদ্যালয়ই লাল ক্যাটাগরিতে রয়েছে। খোদ ঢাকার বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান যদি এমন হয় তাহলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান সহজেই অনুমেয়।
সূত্র আরও জানায়, এক মাস ধরে দেশের ১২টি জেলার ২০ উপজেলার মোট ৪৮৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে সবুজ ক্যাটাগরিতে স্থান পাওয়া গেছে মাত্র ছয়টি বিদ্যালয়ের। হলুদে স্থান পেয়েছে ১৬১টি আর লালের ঘরে রয়েছে বাকি ৩১৬টি বিদ্যালয়। সবুজে স্থান পাওয়া বিদ্যালয় ছয়টি হলো- মৌলভীবাজার সদরের একটি, খুলনা সদরের দু’টি, দিনাজপুর সদরের তিনটি। বাকি হলুদ ও লাল ক্যাটাগরিতে রয়েছে ঢাকার তিন থানা, মুন্সীগঞ্জের সদর এবং গজারিয়ার ২৩টি স্কুল, পটুয়াখালী সদরের ৩৩টি স্কুল, খুলনার ৪৬টি স্কুল, লক্ষ্মীপুর সদরের ৪৯ স্কুল, কিশোরগঞ্জ সদরের ৩৩ স্কুল, দিনাজপুর সদরের ৩৭ স্কুল, নোয়াখালী সদরের ৫০ স্কুল, ঝালকাঠি সদরের ৩৮ স্কুল, নেত্রকোনার দুই উপজেলার (সদর, বারহাট্টা) ৩০ স্কুল, রাজবাড়ী সদরের ৩৮ স্কুল, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ৩৪ স্কুল, বরিশালের উজিরপুর ও আগৈলঝাড়ার ১২ স্কুল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের এই ক্যাটাগরি নির্ধারণে আন্তজাতিক স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের শিখন মান অনুযায়ী লালের জন্য যে শতকরা (০০ থেকে ৬০ শতাংশ) হার নির্ধারণ করা হয়েছে এটি অনেক বেশি। প্রকৃত অর্থে এই হার নির্ধারণ করা দরকার ০ থেকে ৪০ শতাংশ। তাহলে লালের হার কমে আসবে। সেই সাথে বাড়বে সবুজের হার। এটি নিয়েও কাজ করা হচ্ছে। আগামীতে এই শিখন হারের শতকরা হার পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা হবে।
প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কার পরামর্শ কমিটির আহবায়ক ড. মনজুর আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আগে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তার পরই এগুলো সমাধানে কাজ করতে হবে।
তিনি জানান, আমাদের বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে কিছু সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের চরিত্র ভিন্ন রকম। আশা করি সংস্কারগুলো নিয়ে তারা কাজ করবে।