দিনাজপুরে খামারি মোবাইল অ্যাপ ও ক্রপ জোনিং সিস্টেমের উপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত


দিনাজপুর প্রতিনিধি ঃ দিনাজপুরে কৃষি কর্মকর্তাদের নিয়ে খামারি মোবাইল অ্যাপ ও ক্রপ জোনিং সিস্টেমের উপর কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রবিবার (২০ এপ্রিল ২০২৫) বালুবাড়ীস্থ দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মিলনায়তনে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) আয়োজনে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মশালায় কৃষি কর্মকর্তাদের সামনে টেকসই কৃষি উন্নয়নে স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তিঃ খামারি মোবাইল অ্যাপ বিষয়ের বিস্তারিত দিক তুলে ধরা হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল-বিএআরসি’র এইআরএস বিভাগের সদস্য পরিচালক মোঃ মোশাররফ উদ্দিন মোল্লা’র সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ডিএই দিনাজপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মোঃ রিয়াজ উদ্দিন।
কর্মশালায় বিভিন্ন বিষয়ের উপর বক্তব্য উপস্থাপন করেন বিএআরসি’র ক্রপ জোনিং প্রকল্পের সয়েল এক্সপার্ট মোঃ ছাব্বির হোসেন, ক্রপ জোনিং প্রকল্পের কম্পিউটার ও জিআইএস ইউনিট এবং পিআই পরিচালক হাসান মোঃ হামিদুর রহমান ও বিএআরসি’র ক্রপ জোনিং প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোঃ আবিদ হোসেন চৌধুরী।
কর্মশালায় জানানো হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবাদি জমির পরিমান হ্রাস, ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ এবং কৃষি উপকরণের কার্যকর ও সঠিক ব্যবহার, গবেষণার সাথে মাঠ পর্যায়ে ফলনের পার্থক্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন বর্তমান কৃষি। ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমি এবং সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের বিপরীতে বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দিতে হলে কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে টেকসই কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রনয়ন ও লাগসই প্রযুক্তির প্রয়োগ অপরিহার্য।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কৃষির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় টেকসই কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা প্রনয়নের লক্ষ্যে ২০১৭ সাল হতে ক্রপ জোনিং বাস্তবায়ন করছে। উপজেলাভিত্তিক ভূমি ও মৃত্তিকা এবং জলবায়ুর তথ্য-উপাত্ত ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণে জিওস্পেশাল প্রযুক্তি (জিআইএস, রিমোট সেনসিং, জিপিএস) ব্যবহার করে ক্রপ জোনিং উন্নয়নের কাজ চলমান। ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা বিবেচনায় ক্রপ জোনিং অনুযায়ি ফসল উৎপাদন পরিকল্পনা করা হলে ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে ৪৫৮টি উপজেলায় ৭৬টি ফসলের উপযোগিতা নিরুপন, ফসল জোন নির্ধারন এবং সার সুপারিশ প্রনয়ন সম্পন্ন হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে কৃষকসহ অন্যান্য উপকারভোগির নিকট উন্নত কৃষি সেবা প্রদানে ফসল উৎপাদন পরামর্শক হিসাবে ‘খামারি’ মোবাইল অ্যাপ তৈরী করা হয়েছে। অ্যাপটি জিওস্পেশাল প্রযুক্তি নির্ভর একটি স্মার্ট কৃষি অ্যাপ, ফলে কৃষক নিজ জমিতে দাড়িয়ে তাৎক্ষনিকভাবে সেই জমির জন্য উপযোগি ফসল, সার সুপারিশসহ অন্যান্য তথ্য সহজেই জানতে পারবে। খামারি অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে জমির উপযোগি ফসল আবাদ এবং সেই ফসলের জন্য সুপারিশকৃত সার প্রয়োগ করা হলে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষাসহ অধিক ফলন প্রাপ্তি ও আর্থিক লাভ অর্জিত হবে। খামারি অ্যাপটি বাংলায় প্রস্তুত করায় এটি সহজেই বোধগম্য এবং এর ব্যবহার পদ্ধতি কৃষকবান্ধব।
টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণে খামারি অ্যাপটি বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি চর্চা অনুসরণে কৃষকদের সক্ষম করে তুলবে।
খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সেবার কার্যকারিতা যাচাই খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশের কার্যকারিতা যাচাইয়ে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমভূক্ত প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় ২০২২-২৩ সালে ৩৮টি উপজেলায় রবি, খরিপ-১ এবং খরিপ-২ মৌসুমে মোট ১১টি ফসলের প্রদর্শনী ট্রায়াল এবং ২০২৩-২৪ সালের রবি মৌসুমে ৬০টি উপজেলায় বোরো ধানের প্রদর্শনী ট্রায়াল কৃষকের জমিতে বাস্তবায়ন করা হয়। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, ২০২২-২৩ সালে খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে রবি মৌসুমের ৭টি ফসলের (বোরো ধান, গম, ভুট্টা, আলু, সরিষা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ) ১৬টি প্রদর্শনী
চন্ডীর তুলনায় সার খরচ ১৩.২২% কম ও ফলন বৃদ্ধি ১০.৪৩% এবং ২০২৩ সালে খরিফ-১ মৌসুমের ৩টি ফসলের (পাট, তিল, মুগ ডাল) ৭টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে ২৭.৩৪% কম সার খরচ ও ১০.০৪% ফলন বৃদ্ধি হয়েছে। খরিফ-২ মৌসুম ২০২৩ সালে আমন ধানের ৩৪টি প্রদর্শনী ট্রায়ালের গড় ফলাফলে সারের খরচ ৩৩.৯৯% কম ও ৬.৮৩% ফলন বৃদ্ধি হয়েছে এবং ২০২৩-২৪ সালের রবি মৌসুমে বোরো ধানের ৬০টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে ১৮.২১% কম সার খরচ ও ৫.৫৯% ফলন বৃদ্ধি হয়েছে।
আমন ধানের ৩৪টি প্রদর্শনী ট্রায়ালে খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে কৃষক চর্চার তুলনায় সার খরচ প্রতি হেক্টরে ৪,৭৩৫ টাকা সাশ্রয় এবং ৩৪০ কেজি ফলন বৃদ্ধি যার মূল্য ৩২ টাকা কেজি হিসেবে ১০,৮৮০ টাকা অর্থাৎ হেক্টর প্রতি মোট আর্থিক লাভ ১৫,৬১৫ টাকা হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ৫৭ লক্ষ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সার সংক্রান্ত খামারি অ্যাপের সুপারিশ দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ৮৯৬৫ কোটি টাকা আর্থিক লাভ অর্জন করা সম্ভব হতো।
খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহারে কৃষক চর্চার তুলনায় প্রতি হেক্টরে সার খরচ ৩,৭৪২ টাকা সাশ্রয় এবং ৩৯০ কেজি ফলন বৃদ্ধি যার মূল্য ৩২ টাকা কেজি হিসেবে ১২,৪৮০ টাকা অর্থাৎ হেক্টর প্রতি মোট আর্থিক লাভ ১৬,২২২ টাকা হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে ২০২৩-২৪ সালে বাংলাদেশে ৫০,৫৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে খামারি অ্যাপ প্রদত্ত সার সুপারিশ ব্যবহার করা হলে দেশব্যাপী প্রায় ৮২০৫ কোটি টাকা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।