বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, রেজি নং-৩৬)

ক্যারামের জৌলুশ কেড়েছে স্মার্টফোন, চলছে অস্তিত্বের লড়াই

ক্যারামের জৌলুশ কেড়েছে স্মার্টফোন, চলছে অস্তিত্বের লড়াই

মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : ক্রীড়াঙ্গন ছাপিয়ে গ্রামীণ খেলাও ছুঁয়েছে স্মার্টপ্রযুক্তি। ক্যারাম, লুডু, দাবা— কি নেই প্রযুক্তির দুনিয়ায়। এসব খেলা এখন হাতের মুঠোয়। স্মার্টফোনে, যখন-যেখানে যেকোনো সময় খেলা যাচ্ছে বলে মোবাইলেই ডুব দেন বেশিরভাগ মানুষ। গ্রামীণ জনপদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্যারামের জৌলুশও কেড়ে নিয়েছে স্মার্টফোন। আর এতেই কপাল পুড়েছে এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের, চলছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।

তবে প্রযুক্তির সঙ্গে পেরে না উঠায়, অনেকেই ছেড়েছেন এ শিল্প। যারা টিকে আছেন তারা লড়াই করছেন— আশঙ্কা; যেখানে হোঁচট খেলেই হতে হবে বিলীন। তবু যারা লড়ছেন তাদের একজন মো. মনির হোসেন। এ ব্যবসায় তার দীর্ঘ ২৮ বছর। পুরান ঢাকার আগামসি লেনে নিজের কারখানায় কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।
মনির হোসেন বলেন, ‘একটা ক্যারাম বোর্ড প্রস্তুত করতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। বোর্ড কাটিং-ফিনিশিং থেকে শুরু আছে রঙতুলির খেলা। সব মিলে একটা শিল্প। যেখানে অনেক বেশি মেধা খাটাতে হয়। প্রয়োজন হয় অভিজ্ঞতার। দীর্ঘ খাটুনির পর একটা বোর্ড তৈরি করা হয়। আগে অনেক চাহিদা ছিল— ব্যবসাও ছিল।’ তিনি বলেন, ‘সর্বনিম্ন ২৪ ইঞ্চি থেকে সর্বোচ্চ ৫৬ ইঞ্চি পর্যন্ত ক্যারাম বোর্ড হয়। ২৪ ইঞ্চির বোর্ড আমরা মার্কেটে পাইকারি বিক্রি করি ২২০ টাকায়। সেখানে আমাদের লাভ থাকে ১০-১৫ টাকা। আর বড়গুলোতে আগের চেয়ে কম লাভ হয়। এখন ক্যারাম বোর্ডের চাহিদা কম; ব্যবসাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। অনেক ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা যারা টিকে আছি; জানিনা কতদিন থাকতে পারবো।’  মুখ থুবড়ে পড়া বোর্ড ভিত্তিক এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কারিগররাও জীবিকা হারাচ্ছেন। মো. সবুজ নামে এক কারিগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা ভালো নেই। মোবাইলে লুডু-ক্যারাম চলে আইছে। এই কারণে আমাদের ব্যবসা প্রচুর খারাপ যাইতেছে। আগে মাসে সেল (বিক্রি) হইতো ৪-৫শ পিস এখন ২-৩শ পিসও বিক্রি হয় না। আগে তো খুব ভালো আছিল, ভালো চলতো। কিন্তু এখন তো ৪ ভাগের এক ভাগও চলে না। আগের তুলনায় এখন কিছুই নাই। এখন কোনরকম দিন যাওয়া আরকি। মালিকের ঘর ভাড়া দিতেই কষ্ট হয়। আগে ৫-৬ জন করে কারিগর আছিল এখন ২ জনই রাখতে পারে না। আমি এই লাইনে কাজ করি দীর্ঘ ১০-১৫ বছর। আগে ওভারটাইম মিলিয়ে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় করতাম। মাসে বেতন পায় ১০ হাজার তার সঙ্গে ওভারটাইম পাইতাম ৫ হাজার। এখন বর্তমানে বাড়তি ৫-৬ হাজার তো দূরে ওই ১০ হাজার টাকা বেতন ছাড়া আর কিছু নাই।’

তিনি বলেন, ‘খুব কষ্টে জীবন চলতেছে। নিজে চলতেই সমস্যা হচ্ছে; সংসার চালাইতেও হিমশিম খাচ্ছি।’ জামাল হোসেন নামে আরেক কারিগর বলেন, ‘মোবাইলফোনে ক্যারাম গেমস চলে আসায় ক্যারাম বোর্ডের চাহিদাটা এখন কম। আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে কাজ করছি। আগে যে জৌলুশ দেখেছি সেসবের কিছুই নাই এখন। সবকিছু কেড়ে নিয়েছে ওই মোবাইলফোন।’

যেভাবে তৈরি হয় ক্যারাম বোর্ড
কম্পাস হাতে কালির সংমিশ্রণে সুনিপুণভাবে বোর্ডের নকশা করছেন এক শিল্পি। এগিয়ে যেতেই সেগুলো ফুটে ওঠে আরও সুন্দরভাবে। কথা হয় পুরান ঢাকার বাশার ক্যারাম বোর্ডের এই কারিগর সৌরভের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘বোর্ডে নকশার কাজগুলো আমরা হাত দিয়েই করি। এগুলোর ফর্মা আছে, ফর্মা দিয়েই করি। আগে ফর্মাটা তৈরি করি তারপর হাত দিয়েই করি। আর যে কালিটা আছে এটাকে মাস্টার কালি বলে। প্রথমে আমরা পানি দিয়ে কাজ করি এরপর পোলিশ করি, পোলিশ করার পর অন্তত ১-২ বছরে এগুলো আর উঠবে না।’ কোন কাঠের ক্যারাম বোর্ড সবচেয়ে বেশি ভালো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো তাল গোদা। এই কাঠের বোর্ডের দাম ৯-১০ হাজারের মতো। এই কাঠ আমরা বেশি পাই না। কম পওয়া যায় তাই দামটাও বেশি। মানের দিক দিয়ে অনেক ভালো। এছাড়া মেহগনি, বেল কাঠ, কাঁঠাল কাঠ দিয়েও ক্যারাম বোর্ড বানানো হয়।’

ব্যবসার হালচাল 
পুরান ঢাকার আগামসি লেনের মালেক এন্টারপ্রাইজের মালিক ইব্রাহিম। ব্যবসার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘খরচের সঙ্গে বিনিয়োগ ম্যানেজ করে কুলানো যায় না। আগে এক কেজি পেরেকের দাম ছিল ৬০ টাকা এখন হয়ে গেছে ১৬০ টাকা। এখন জিনিস পত্রের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাইছে তাতে জিনিসপত্র কিনে ব্যবসা করা দায়। কাঠ যা আগে কিনতাম ১৮০ টাকা এখন তা হয়ে গেছে ৩৬০-৩৭০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা।  এছাড়া ভালো কোয়ালিটির মাল বানিয়েও মার্কেটে ভালো দাম পাওয়া যায় না। ওছাড়াও এখন আগের আড্ডার জায়গা মোবাইল দখল করেছে। মোবাইল গেমসের কারণে এখন ক্লাবে বা চায়ের দোকানে ওইভাবে আর কেউ ক্যারাম খেলে না। তাই আমাদের ব্যবসাও এখন তলানির দিকে।’

বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন