রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, যার রেজি নং-৩৬)

সংবাদ শিরোনামঃ

শ্রীমঙ্গলের ইউএনও’র উদ্যোগে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে স্কুলে চালু হয়েছে রিডিং এন্ড রাইটিং হাঁসপাতাল

শ্রীমঙ্গলের ইউএনও’র উদ্যোগে দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে স্কুলে চালু হয়েছে রিডিং এন্ড রাইটিং হাঁসপাতাল

 

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

বিগত করোনা মহামারির সময়ে লেখা পড়ায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন নিয়েছেন এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। উনার উদ্যোগে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ১৩৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ইতোমধ্যে ৮৬টি বিদ্যালয়ে চালু হয়েছে রিডিং এন্ড রাইটিং হসপিটাল। বাকী বিদ্যালয় গুলো আন্ডার কন্সট্রাকশনে রয়েছে।
গত বুধবার দুপুরে শ্রীমঙ্গল কালাপুর ইউনিয়নের কাকিয়াবাজার সংলগ্ন সিংহবীজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরেজমিনে গেলে শিক্ষক কেয়া চক্রবর্তী জানান, ২য় তলায় তাদের হাসপাতাল। উপরে উঠে দেখতে পাওয়া যায় একটি কক্ষের সামনে বিলবোর্ডে রয়েছে রিডিং এন্ড রাইটিং হসপিটাল, অপর একটি কক্ষের সামনে আরো একটি বিলবোর্ডে, রিডিং রাইটিং হসপিটাল চেকিং রুম।
প্রথমে রিডিং রাইটিং হসপিটালে প্রবেশ করি। চোখে পড়ে ৬টি গ্রæপে ৫ জন করে ৩০জন শিশু লুডু খেলায় মত্ত। এ প্রতিবেদককে দেখে এগিয়ে এলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুবি রায়। যার বর্তমান পরিচয় তিনি রিডিং এন্ড রাইটিং হাসপাতালের কনসালট্যান্ট। রুবি রায় জানান, শিশুরা খেলে খেলে অক্ষর, যুক্তাক্ষর, ইংরেজি ওয়ার্ড, অংক শিখছে। এটি একটি বিশেষ কৌশল যা প্রণয়ন করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন। এ সময় ক্লাসে আসেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মলয় কান্তি তালুকদার। মলয় কান্তি তালুকদার বলেন, এই রির্ডিং হসপিটালে তার পদবী “তত্ত¡াবধায়ক”। তিনি বলেন, বিগত করোনায় লেখা পড়ায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান বাড়াতে তারা অভাবনীয় একটি ফরমুলা পেয়েছেন। যা দিয়েছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার। এই ফরমুলাটি হলো বিদ্যালয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী লেখা পড়ায় অনেক দূর্বল। অনেকে যুক্তাক্ষর পড়তে পারেনা। অনেক বড় বানান উচ্চারণ করতে পারেনা। অনেকে ইংরেজি শব্দ শিখেনি। করোনা মহামারির সময়ে যেগুলো না পড়েই তারা উপরের ক্লাসে চলে এসেছে। এই পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রথমে বর্ণমালা, শব্দ ও ওয়ার্ড দিয়ে কয়েকটি লুডু তৈরী করে দিয়েছেন। আর এই লুডু খেলার জন্য প্রথমে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর লাল ও সবুজ দুই দলে বিভক্ত করি। লাল দলে রয়েছেন যারা শব্দ ভালো করে উচ্চারণ করতে পারেনা, যুক্তবর্ণের ব্যবহার জানেনা। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের অধিকতর দুর্বল শিক্ষার্থী। আর সবুজ দলে রয়েছেন যারা রিডিং পড়তে ও লিখতে পারে। তার বিদ্যালয়ে প্রাথমিক বাছাইয়ে লাল দলের শিক্ষার্থী পেয়েছেন ৩০ জন। এই ৩০ জনের জন্য সবুজ দল থেকে ভালো দেখে প্রতি ৪ জনে একজন করে শিক্ষার্থী বাছাই করেছেন, যে শিক্ষার্থী ভালো করে রিডিং পড়তে পারে। যাদের পদবী হচ্ছে নার্স বা কেয়ারার। এই একজনকে দিয়ে ৪ জনের গ্রæপ করে বড় একটি লুডু খেলতে বসিয়ে দেন। এই লুডুটির প্রত্যেক ঘরে রয়েছে বর্ণমালা। একই ভাবে একটি লুডু রয়েছে ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে। আরো দুইটি বাংলা ও ইংরেজি শব্দ দিয়ে। শিক্ষার্থীরা লুডুতে কটি মেরে ওই ঘরে গুটি নিয়ে যায় এবং সাথে সাথে পড়তে থাকে । প্রথমে একবার পড়িয়ে দেন সবুজ দল থেকে আসা দলনেতা বা ঐ হাসপাতালের নার্স। জটিল বানানে সাহায্য করেন ডাক্তার ও কনসালটেন্ট।
তিনি জানান, এই রিডিং হাসপাতালটি খোলা হয় প্রতিদিন বিকাল ২টার পর থেকে। এখানে কয়েকদিন ক্লাস করার পর যারা সব পড়তে পারে তাদের পাঠানো হয় রিডিং রাইটিং হসপিটালের চেকিং রুমে। সেখানে থাকেন খুবই ভালো মানের আরেকজন শিক্ষার্থী। যার পরিচয় তিনি ওই হাসপাতালের ডাক্তার।
ডাক্তারের ভুমিকায় থাকা চতুর্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থী তন্ময় চক্রবর্তী জানায়, রিডিং রাইটিং হসপিটালের চেকিং রুমে যারা আসেন তাদেরকে আরো কিছু ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এখানে দেয়ালে টাঙ্গানো কয়েকটি ছবি দেখে গল্প বলতে হয় এবং তা লিখে দিতে হয়। ফলের গাছের ফলগুলো পড়তে হয়। ইংরেজী বর্ণমালার গাছগুলো থেকে বর্ণমালা ও ওয়ার্ড পড়তে হয়। সব শেষে পেপার স্ট্যান্ডে গিয়ে পড়তে হয় পত্রিকা। এখানেই শেষ নয় এই চেকিং রুমে যে সবচেয়ে ভালো করবে তাকে দেয়া হয় “স্টুডেন্ট অফ দ্য ডে” পুরস্কার।
তন্ময় চক্রবর্তী জানান, চেকিং রুমের কাজ যারা সুন্দরভাবে করে দিতে পারেন তারা আবার ক্লাসে ফিরে যান। আর যারা পারেন না বা জড়তা থাকে তাদের আবার ফেরত পাঠানো হয় রিডিং রাইটিং হসপিটালে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন জানান, “তার রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে একটি হলো বিভিন্ন বিদ্যালয় পরিদর্শন করা। আর এই বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে গিয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করলে বেশ কিছু শিক্ষার্থী উত্তর দিতে পারে না। ৩য় থেকে ৫ম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী রিডিং পড়তে পারেনা। দূর্বল শিক্ষার্থীদের বিষয়ে জানতে চাইলে ওই সময় শিক্ষকরা তাকে জানান, এরা করোনা মহামারির সময় পড়তে পারেনি। কিন্তু উপরের ক্লাসে তুলে দিতে হয়েছে। এ জন্য এরা দূর্বল।
আলী রাজিব মাহমুদ মিঠুন আরো জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে এর কৌশল খোঁজেন এবং টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে এই ফরমুলাটি তৈরী করেন। তিনি জানান, এই ফরমুলাটি তৈরী করতে বড় উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা জনাব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া। আর এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা পরিবার অর্থাৎ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সহকারী শিক্ষা অফিসার, উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার এবং বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোমের কারণে। তিনি বলেন, এ কার্যক্রমের পুরো বিষয়টি জেলা প্রশাসক, মৌলভীবাজার সরাসরি তত্ত¡াবধান ও নির্দেশনায় বাস্তবায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। জেলা প্রশাসক নিজেও একজন শিক্ষানুরাগী ও জাতীয় পর্যায়ে পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আমার ভালো লাগছে এই জন্য যে, এ রিডিং রাইটিং হসপিটালে ভর্তি হয়ে অনেক দূবল শিক্ষার্থী সবল হয়েছে।
এ ব্যাপারে সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আন্তরিক সহযোগিতা ও তত্ত¡াবধানে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় এই রিডিং রাইটিং হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হয়েছে। এ জাতীয় একটি হাসপাতাল খুলতে খরচও তেমন না। ডিজিটাল ভাবে করলে  ৭/৮ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যায়। আর কাগজ দিয়ে করলে ১৫ টাকার মধ্যে হবে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা জ্যোতিষ রঞ্জন দাশ জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আন্তরিক সহযোগিতায় পুরো উপজেলা জুড়ে চমৎকার এই কার্যক্রমটি চালু করা হয়েছে । উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পাশাপাশি তাদের সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ব মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া এ বিষয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। তিনি স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের এ বিষয়ে প্রথমে প্রশিক্ষণ দেন এবং হাসপাতাল খোলার কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এই কার্যক্রমের আরোএকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তৃতীয় শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত  বাংলা ও ইরেজীতে যত বানান রয়েছে বিশেষ করে যুক্তবর্ন সবগুলো শব্দ দিয়ে তিনটি ডিকসনারী তৈরী করা হয়েছে। যা এই রিডিং রাইটিং রোমে পড়ানো হয়। তিনি জানান, এই কোর্সটি শেষ করতে দুই থেকে আড়াই মাস ভর্তি থাকতে হয় রিডিংএন্ড রাইটিং হাসপাতালে। তবে কেউ কেউ ১৫ দিনেও রিডিং আওত্বে নিয়ে আসে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কল্যাণ দেব জানান, এই উদ্যোগটি চমৎকার। যা সরাসরি আমাদের বিদ্যালয়ের উপকার হচ্ছে। বিশেষকরে দুর্বল শিক্ষার্থীদের পড়ানোর জন্য আলাধা করে শিক্ষক পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে ভালো ছাত্ররাই ডাক্তার ও নার্সের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দূর্বল শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এ কার্যক্রমে খুশি অভিবাবকরাও। শ্রীমঙ্গল সিংহব্রীজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম খান জানান, এর ফলে আমাদের সন্তানদের অনেক উপকার হচ্ছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসারের ব্যাতিক্রমী এই শিক্ষা কার্যক্রমের সংবাদ উপজেলা ছাড়িয়ে চলে যায় জেলায়। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন এবং এটি পুরো জেলায় ছড়িয়ে দিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি), মৌলভীবাজার বনার্লী পাল এর নেতৃত্বে একটি টিম পাঠান শ্রীমঙ্গলে।

বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন