বোরোর বাম্পার ফলনেও কৃষকের মুখে হাসি নেই
গাইবান্ধা প্রতিনিধিঃসম্প্রতি গাইবান্ধার নিভৃত অঞ্চলে দেখা গেছে, কৃষকের মাঠে দুলছে পাকা ধান। লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান কাটার উপযুক্ত সময় হলেও পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিক না থাকায় জমির ধান ঘরে ওঠানো নিয়ে আতঙ্কে আছেন কৃষকরা। হঠাৎ শিলাবৃষ্টি কিংবা ঝড় হলে ধানের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তা বলা বাহুল্য।
দিগন্তজুড়ে নজর কাড়ছে বোরো ধান। ইতোমধ্যে খেতের ধান পাকতে শুরু করেছে। কেউ কেউ কাটা-মাড়াইও করছেন। এরমধ্যে দেখা দিয়েছে আকাশের বিরূপ আচরণ। কখনও কালো মেঘে ঢাকছে আবার কখনও গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এ অবস্থায় পাকা ধান ঘরে তুলতে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন অনেকে। এই বুঝি শেষ সময়ে কষ্টের ফসল নষ্ট হয়ে যাবে।
অক্লান্ত পরিশ্রম করে সেই ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছেন কৃষরা। তবে সঠিক দাম না পাওয়ার আশঙ্কায় হাসি নেই তাদের মুখে।চলতি মৌসুমজুড়েই ছিলো বৈরী আবহাওয়া। প্রথম দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় মোটরে পানি তুলে জমি প্রস্তত করেন কৃষকরা। ধান লাগানোর পর নিয়মিত সেচও মোটরের পানিতে দেওয়া লাগে তাদের। এছাড়া তুলনামূলক উচ্চ মূল্যে সার, শ্রমিক, কীটনাশক খরচ করে যখন ধান পাকার সময় আসলো, তখনই অধিকাংশ ক্ষেতে বাদামি গাছ ফড়িংয়ের (কারেন্ট পোকা) আক্রমণ শুরু হয়। এতেও অনেক খরচ করে কীটনাশক ও অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
উৎপাদন খরচ ও বাজার দরের বিরাট পার্থক্যের কারণে হতাশাগ্রস্ত কৃষকের মুখে এবার হাসি ফোটেনি। অধিকাংশের ধারণা, ধান বিক্রির টাকায় সার-বীজ-কীটনাশকের দোকানের দেনাও শোধ করতে পারবেন না তারা। এভাবে লোকশানের কারণে কৃষি কাজে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে চলতি মৌসুমে জেলায় বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অর্জন হয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৪০ হেক্টর। এ থেকে প্রায় ৮ লাখ ৬২ হাজার মেট্রিক টন ধান ও ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সম্ভাবনা রয়েছে।
মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া কিছুটা খারাপ থাকায় উৎপাদন খরচ বাড়লেও ফলনে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় কারেন্ট পোকার আক্রমণ বেশি ছিলো। এতে বেড়েছে কীটনাশক ব্যয়। গত ৭ দিন আগে থেকে এ অঞ্চলে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এলাকার সম্পূর্ণ কাটা ঝাড়া শেষ করতে আরও অন্তত ১০-১৫দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
রবিবার (১২ মে ) বিকেলে সরেজমিনে পলাশবাড়ীর কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, যেসব এলাকার ক্ষেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ হয়নি, সেসব এলাকার চাষিরা ধানের বাম্পার ফলন পেয়েছেন। তবুও উৎপাদন খরচ ও বাজার দরের পার্থক্যের কারণেই হতাশাগ্রস্ত বেশিরভাগ চাষি। তাদের মুখে নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দ আসেনি।
তারপরও ধান ঘরে তোলার বিষয়টি মাথায় রেখে সার-কীটনাশক ব্যবসায়ী, সেচ পাম্প ও ট্রাক্টর মালিকরা তাদের বকেয়া আদায়ে হালখাতার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছেন। এই হালখাতা নামটি হতাশাগ্রস্ত কৃষকের কাছে যেন বিষফোঁড়া।
অধিকাংশ কৃষকের দাবি, ধানের উৎপাদন ভালো হলেও তাদের খরচের টাকা উঠছে না।
উপজেলার মহদীপুর ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের কৃষক মজনু, তাজু, এজাদুল,আলম, মইনুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন জানান, জায়গা জমি কম থাকায় তারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে ধান চাষ করে থাকেন। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু তারপরও খরচের টাকা উঠছে না।
তারা খরচের হিসেব দিয়ে বলেন, এ বছর এক বিঘা লিজ নিতে জমির মালিককে দিতে হয়েছে সর্বনিম্ন ৮ হাজার টাকা। প্রথমেই এক বিঘা জমির জন্য বীজতলা তৈরি করে চারা উৎপাদন করতে খরচ হয় দুই হাজার টাকা। তারপর জমি চাষ করতে লাগে ১ হাজার ৫০০ টাকা। জমিতে চারা রোপণ করতে খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকা, আগাছা অপসারণ বাবদ ব্যয় হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার টাকা, তিনবারে ডিএপি, টিএসপি, এমওপি ও ইউরিয়া সার মিলে কমপক্ষে দুই হাজার টাকার রাসায়নিক সার লাগে। আগাছানাশক, পোকা দমন ও পচন রোধে অন্তত দেড় হাজার টাকার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়।সর্বশেষ এক বিঘা জমির ধান কাটতে, বহন করতে ও মাড়াই করে গোলাজাত করতে ছয় হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে সময় মতো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সেচ বাবদ পাম্পের মালিককে এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হবে। কোনো কোনো গ্রামে সেচ বাবদ পাম্প মালিকদের তিন-চার হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।তারা বলেন, সবমিলিয়ে আমরা যদি নিজেদের শ্রমের মজুরির টাকা বাদও দেই, তারপরও এক বিঘা জমির ধান উৎপাদন করতে কমপক্ষে বিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। একবিঘা জমিতে গড়ে বিশ মণ ধানও উৎপাদন হয় না। বর্তমান বাজারে এক হাজার ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ টাকা মণ হাতে ধান বিক্রি হচ্ছে। তাহলে বাম্পার ফলনে কৃষকের লাভ কী হলো?
পলাশবাড়ী কৃষিবিদ কৃষি কর্মকর্তা ফাতেমা কাউসার মিশু বলেন, এ বছর ধানের ফলন ভালো হয়েছে। আমরা প্রতিটি ইউনিয়ানে আমন চাষিদের প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা বোরর বাম্পার ফলন হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছি।