বুধবার, ২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, রেজি নং-৩৬)

সদ্য সংবাদ:

বন উজাড় করে ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ “ধোঁয়া ও ধুলাবালির হুমকির মুখে পরিবেশ”

বন উজাড় করে ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ “ধোঁয়া ও ধুলাবালির হুমকির মুখে পরিবেশ”

পীরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধিঃ রংপুরের পীরগঞ্জে অধিকাংশ ইটভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে বনের কাঠ। শুধু লোক দেখানোর জন্য ভাটায় কিছু কয়লা রেখে জ্বালানি কাজে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে বনের কাঠ। জ্বালানি কাজে কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা তোয়াক্কা করছে না ইটভাটার মালিকেরা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কয়লার পরিবর্তে কাঠ দিয়েই অবাধে পোড়ানো হচ্ছে ইট। ভাটার ধোঁয়া পরিবেশ নষ্ট করছে এবং ভাটার কাজে নিয়োজিত গাড়ি চলাচলে ধুলাবালির কারনে এলাকার কোমলমতি স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েসহ পথচারীদের শ্বাসকষ্ট জর্নিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
ভাটা এলাকার লোকজন বলছেন, অধিকাংশ ইটভাটার নেই কাগজপত্র তারপরও ইট পোড়ানোর কাজে এরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরকারি বিধি লংঘন করে বন এলাকায় এবং স্কুল কলেজসহ বসতবাড়ির পাশেই গড়ে তুলেছে ইটভাটা।
এছাড়াও প্রতিদিন হাজারো মহেন্দ্র দিয়ে কৃষি জমির মাটি ভাটায় বহন করা হচ্ছে, ইটভাটাগুলো নির্বিচারে মাটি গিলে, পোড়া ইট বের করছে। ইটভাটার গাড়ি স্কুল কলেজ, হাটবাজারের পরিবেশ নষ্ট করছে এবং রাস্তাঘাটের বাকল বা ছাল তুলছে। এদের কারনে এলাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত কয়েক বছরে কিছু প্রাণ কেড়ে নিয়েছে অবৈধ ভাটার গাড়ি। অদক্ষ ছোট ছোট ছেলে ড্রাইভার দিয়ে গোটা উপজেলা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ মহেন্দ্র্র গাড়ি। এদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ, নেই কোনো কাগজপত্র।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার সুযোগে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে লাভের আশায় এই এলাকায় বেশিরভাগ ইটভাটার মালিকেরা বনের কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর কাজ করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে সব ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো নিষেধ। কোন ইটভাটায় যদি বনের কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পীরগঞ্জ উপজেলায় মোট ৪২ টি ইটভাটায় চলতি বছর ইট পোড়ানো হচ্ছে যার মধ্যে ১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ২শত থেকে ৫শত মিটারের মধ্যে। এইসব ইটভাটাগুলোর জমির মালিকানা ছাড়া কোন কাগজপত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই কোন ছাড়পত্র। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনেরও কোন অনুমতি নেই ভাটায় আগুন দেয়ার জন্য। সেইসাথে ইউনিয়ন পরিষদের ট্যাক্সও দেয় না ভাঁটা মালিকরা। ভাটাগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবৈধভাবে প্রায় দেড় যুগ ধরে ফিল্ডে ড্রাম চিমনি দিয়ে কাঠ ব্যবহার করে ইট পোড়ানো হচ্ছে। বেশিরভাগ ভাটাতেই কয়লার বালাই নেই। ইটভাটার আশপাশের গ্রামে প্রায় বিশ হাজারের উপরে লোক বসবাস করে। ইট পোড়ানো কাঠের ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। কালো ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০ সহ¯্রাধিক কোমলমতি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। ১৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে অবৈধ ইট ভাঁটা স্থাপন করা হয়েছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চৈত্রকোল ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে ইএসবি আতাউর রহমান আতা, পতœীচড়ায় আর এইস আর রাঙা মন্ডল, এন বি কে রেশমি বেগম, এম পি টি কালাম মিয়া, খালাশপীর এ এইস বি আজির হাজী, এ আর বি রাসেল মিয়া, কাদিরাবাদ এ এস বি শহিদুল ইসলাম, এম ডি বি মাজহারুল ইসলাম, এন আর টি মানিক মন্ডল, টুকুরিয়া এস আর বি এবং অনন্যা উজ্জ্বল মিয়া, শাল্টিতে এইস ই বি মিজানুর রহমান, হোসেনপুর এ এম ডি আব্দুল ওয়াহেদ ব্যাপারী, কুমেদপুর কাঞ্চগাড়ি ও চাক পাড়ায় এফ এফ এম ফারুক মিয়া, কানঞ্চগাড়ি এম ইউ এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ধুলগাড়ি আর এস এস বি সুমন মন্ডলসহ আরো কিছু ভাটায় কয়লার পরিবর্তে বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট পোড়াই করছে।
কয়েকজন ভাটা মালিকের সাথে কথা হলে তারা জানান, কিছু ফিক্সড ভাটা তৈরি করা হয়েছে আর এগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জ্বালানি কাজে কাঠ ব্যবহার করে। এরা কয়লার বাজার সম্পর্কে কিছুই জানেনা। ভাটায় প্রশাসনের লোকজন কখনো জরিমানা বা মোবাইল কোর্ড বসায় না। এরা বড় বাবুদেরকে বস করে কাঠ পোড়ায়, যে কারনে তাদের ভাটায় প্রশাসনের লোকজনের পদধূলি পড়ছে না।
স্কুল কলেজর শিক্ষকরা জানান, উপজেলায় অবৈধভাবে অসংখ্য ভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। কাঠ পোড়ানোর ধোঁয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। ইটভাটার টানে প্রতিবছর কৃষি জমির আবাদ কমতে শুরু করেছে। মাটি কাটা জমি গুলোতে অতিরিক্ত খরচ করে চাষাবাদ করা হচ্ছে। তারপরও কাঙ্খিত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এছাড়াও উপজেলার ভাটা মালিকরা নির্ধারিত মাপের দিক থেকেও পোড়াই ইট অনেক ছোট করছে। তারা শুধু সরকার কেই নয়, জনগণকেও ঠকিয়ে আসছে। এরা সবাইকে ধোকা দিয়ে ইটের মাপ ছোট করছে। এখানে অনেক ভাটায় ইটের মাপ সঠিক নেই। সরকারি নীতি নির্ধারকদের মাপ অনুসারে স্ট্যান্ডার্ড ইটের সাইজ দৈঘ্য ২৪ সেন্টিমিটার (৯ দশমিক ৫ ইঞ্চি) প্রস্থ ১১ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার (৪ দশমিক ৫ ইঞ্চি) এবং পুরুত্ব ৭ সেন্টিমিটার (২ দশমিক ৭৫ ইঞ্চি) সাইজ হবার কথা কিন্তু অনেকই লাভের আশায় ইটের সাইজ ছোট করছে।
উপজেলা ভাটা মালিক সূত্রে জানা যায়, এখানে বেশকিছু ভাটা রয়েছে তারা সরকারি বিধি লংঘন করে গায়ের জোরে কাঠ দিয়ে ইট পোড়াই করে থাকেন। তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। এমনকি এরা ভাটা মালিক সমিতির ধারের কাছেও আসেন না। বনের কাঠ পুড়িয়ে ইট পোড়াই করে কমদামের ইট বিক্রি করে। যে কারনে কয়লা দিয়ে পোড়ানো ইটের বাজার তারা কমিয়ে দিয়েছে। ইটভাটার আশপাশে মালিকরা আগে থেকেই বনের কাঠ স্তুপ (পালা) করে রাখে। ইট পোড়াই মৌসুমে কিছু কয়লা কিনে ভাটার সামনে লোক দেখানোর নামে রেখে দিয়ে বন উজাড় করে কাঠ পোড়ানো কাজে ব্যস্ত এরা এদের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানান।
পীরগঞ্জ উপজেলার একাধিক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানান ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় ইটভাটার মালিকদের ট্রেড লাইসেন্স নেবার কথা থাকলেও তারা ট্রেড লাইসেন্স নেন না বছরের পর বছর।
ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এনামুল ইসলাম জানান ভাটা মালিক সমিতির নির্দেশনা উপেক্ষা করে ইট পোড়ানোর কাজে কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার করছে ফলে ইট উৎপাদনে কাঠ ব্যবহারকারীদের উৎপাদন খরচ কম হচ্ছে তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কয়লা চালিত হাওয়া ভাটা।
উপজেলা বন অফিসার মিঠু তালুকদার এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ইটভাটায় জ্বালানি কাজে কাঠ পোড়া সম্পুর্ণরুপে নিষেধ। কোন ভাটা মালিক পোড়াই কাজে কাঠ পোড়াতে পারবে না। অধিকাংশ ভাটায় দেখা যায় কয়লা লোক দেখানোর জন্য ভাটার সামনে রেখেছে অথচ জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে উপজেলা মহোদয়কে অবগত করেছি এবং তিনি ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।

ভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাদিজা বেগমের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ইতিপূর্বে কিছু ভাটায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে আর মোবাইল কোর্ট অব্যাহত রয়েছে।

বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন