শুক্রবার, ৩রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, রেজি নং-৩৬)

তালায় টিআরএম কার্যক্রমের বকেয়া ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবীতে সাংবাদিক সম্মেলন

তালায় টিআরএম কার্যক্রমের বকেয়া ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবীতে সাংবাদিক সম্মেলন

সেলিম হায়দা :

সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় অবস্থিত কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায় ও ২য় পর্যায়)-এর আওতায় পাখিমারা বিলে বাস্তবায়িত জোয়ারাধার (টিআরএম) কার্যক্রমের বকেয়া ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবীতে সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (২৮ অক্টোবর) সকালে তালা প্রেসক্লাবে পাখিমারা বিলের ক্ষতিগ্রস্ত অধিবাসীর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়। পাখিমারা টিআরএম বিল অধিবাসীদের পক্ষে থেকে মোঃ রবিউল ইসলাম মুক্তি লিখিত বক্তব্য বলেন, আমাদের এ অঞ্চলের কপোতাক্ষ অববাহিকার দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুত ২৬২ কোটি টাকা বরাদ্দের “কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ১ম পর্যায়” প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকারমূলক একটি প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সকল ধরণের ক্ষতিপূরণ প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৬ বছর অধিগ্রহণকৃত পাখিমারা বিলের ১৫৬২ একর জমিতে জোয়ারাধার (টিআরএম) কার্যক্রম চললেও দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা আমাদের জমির ফসলের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ অর্থ এখনো পর্যর্ন্ত পাইনি।

১.ফসলের ক্ষতিপূরণ :
জুন,২০২২ তথ্যানুযায়ী, ১ম পর্যায় প্রকল্পে ৬ বছর টিআরএম চলাকালীন সময়ে আমাদের পাখিমারা বিলের জমির মালিকদের ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়ার কথা ছিল ৪০,০১,৪৬,৯১২ টাকা। সেখানে আমরা ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১ম বছরে পেয়েছি ৫,৭৫,৬৫,৯৩৯.২৮ টাকা (৮৬.৩১%) এবং ২য় বছরে পেয়েছি ৪,৩৭,০৬,৮২৪.৭২ টাকা (৬৫.৫৩%) অর্থাৎ মোট ১০,১২,৭২,৭৬৪ টাকা। প্রথম ২ বছরের বকেয়া টাকাসহ পরবর্তী ৪ বছরের মোট ২৯,৮৮,৭৪,১৪৮ টাকা আমরা এখনো বুঝে পাইনি।
উল্লেখ্য, ক্ষতিপুরণের টাকা উত্তোলনের জন্য সরকারের শর্তানুযায়ী এস,এ খতিয়ানের পর্চা, নামপত্তন, ক্রয়ের দলিল, পিঠ দলিল, হাল জরীপের পর্চা, খাজনা প্রদানের হাল দাখিলা, প্রাপ্য জমির হিসাব বিবরণী, নাগরিক সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি (চেয়ারম্যান কর্তৃক সত্যায়িত) সহ ১২ রকমের কাগজ জেলা প্রশাসকের এল এ শাখায় জমা দিতে হয়। উল্লেখ্য এসকল শর্ত পুরণ করা সাপেক্ষে যাদের প্রথম বছরের টাকা ছাড় করা হয়েছে তাদের অনেকে অজানা কারণে ২য় বছর টাকা উত্তোলন করতে পারেনি। অধিকাংশ কৃষকদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী ৪ বছর (২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১) তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি এবং তাদের জমিতে ফসলও ফলাতে পারেনি।

২.স্থায়ী অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ :
২০১৫ সালে সংযোগ খাল নির্মাণের জন্য ১০.২৮ একর জমি স্থায়ী অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির মালিকরা এখনো কোন ক্ষতিপূরণের অর্থ পায়নি। সংযোগ খালের জন্য ৩৪টি পরিবার বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা বা পূনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি, একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় তাদের গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে মাত্র।

৩. অধিগ্রহণ না হওয়া জমির ক্ষতিপূরণ :
বাস্তবায়িত জোয়ারাধার (টিআরএম) বেসিনের মধ্যে অবস্থিত অনেক জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। এ সকল জমির মালিককেরা জমিতে চাষাবাদ করতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কিন্তু তারা কোন ক্ষতিপূরণের টাকা পায়নি। এমনকি বেসিনের মধ্যে কি পরিমান জমি অধিগ্রহণের আওতায় আসেনি তারও পরিমাণ নির্ধারণ করেনি।

৪. পেরিফেরিয়াল বাঁধের ক্ষতিপূরণ :
এই প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণকৃত বিলের উপর ২০১১-১২ অর্থবছরে বিলের চারিপাশে ১২.৮৭ কি.মি. পেরিফেরিয়াল বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শেষ হয়। এই হিসাবে পেরিফেরিয়াল বাঁধের জমির মালিকদের ১০ বছরের ক্ষতিপূরণ পাওনা হলেও তাদেরকে মাত্র ২ বছরের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। এই জমি চাষাবাদের অনুপোযোগী অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বাঁধ মেরামত করে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পে বিলে টিআরএম চালু করা হবে কি না সে ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে কি সিদ্ধান্ত তা আমরা জানিনা। প্রকল্প শেষে এই বাঁধ অপসারণ করা হবে কিনা অথবা বাঁধের মাটি কে এবং কিভাবে অপসারণ করবে সে বিষয়টিও অনিশ্চিত।

৫৩১ কোটি ৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দের ৪ বছর মেয়াদের “কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প-২য় পর্যায়” (জুলাই ২০২০ হতে জুন ২০২৪) এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ডিপিপি থেকে আমরা যতদুর জানতে পেরেছি টিআরএম বাস্তবায়নের জন্য এ প্রকল্পে ১ম দুই বছরের জন্য একরে প্রতিবছর ৫৩,৭১৩ টাকা হিসেবে মোট ১৬,৭৮,০০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য বরাদ্ধ রাখা হয়েছে। ২য় পর্যায় প্রকল্পে ক্ষতিপূরণের টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে কিন্তু সে অর্থ আমাদের দেয়া হচ্ছে না এবং পেরিফেরিয়াল বাঁধ মেরামত করে টিআরএম চালু করাও হচ্ছে না। এতে একদিকে আমরা সীমাহীন ক্ষতির শিকার হচ্ছি অন্যদিকে নদী নাব্যতা হারিয়ে পুনঃ জলাবদ্ধতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। তিনি আরোও বলেন এই প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কপোতাক্ষ অববাহিকার অধিকাংশ এলাকা দীর্র্ঘদিন যাবত স্থায়ীভাবে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত ছিল। জলাবদ্ধতাজনিত বন্যায় বছরের ৬ থেকে ৮ মাস ফসলের জমিসহ জনপদ প্লাবিত হতো। প্রায় ১০-১৫ লক্ষ মানুষ এই জলাবদ্ধতাজনিত বন্যায় আক্রান্ত হতো। প্লাবিত হতো ঘরবাড়ী, রাস্তাঘাট, হাট বাজার, স্কুল-কলেজ। শত শত কোটি টাকার ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, গাছপালার ক্ষতি হতো। মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তো কাচা-পাকা ঘরবাড়ী ও অবকাঠামো। বিপর্যয়ের মুখে পড়ত স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্কুল-কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতো বছরের প্রায় ৭-৮ মাস। মানুষ আশ্রয় নিত উচু বাঁধ বা রাস্তার উপর, অনেকেই রাত কাটাতো খোলা আকাশের নীচে। সমগ্র এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বড় বড় স্থাপনায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হতো। জলাবদ্ধতাজনিত বন্যার কারণে মানুষ স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে অভিবাসিত হতে বাধ্য হতো। কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (১ম পর্যায়)-এর আওতায় ২০১৫ সালে পাখিমারা বিলে জোয়ারাধার বাস্তবায়ন করা হয়। ফলে সে বছরেই কপোতাক্ষ অববাহিকার সমগ্র এলাকা সম্পূর্ণভাবে জলাবদ্ধমুক্ত হয়। এ প্রকল্পের ফলে এ জনপদের প্রায় ১৫ লক্ষ অধিবাসী প্রত্যক্ষভাবে এবং প্রায় ৪০ লক্ষ অধিবাসী পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে। এ এলাকার প্রধান উৎপাদন সেক্টর কৃষিক্ষেত্রে ব্যপক উৎপাদন বেড়েছে। হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, যোগাযোগসহ এলাকায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় প্রাণ ফিরে এসেছে। ২০১৫ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৮ বছর এ এলাকায় আর জলাবদ্ধা দেখা দেয়নি। পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও কর্মসংস্থানসহ সকল সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। উপরন্তু এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে সামগ্রিকভাবে শত শত কোটি টাকার উপকার হয়েছে। এলাকার নদীসমুহ ফিরে পেয়েছে জীবন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলা, ভূমি গঠন প্রক্রিয়ার পুনরুর্জ্জীবন, পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় টিআরএম অনন্য অবদান রেখেছে।

তিনি জানান,
১ সমগ্র এলকার মানুষের অবর্ননীয় দুঃখ-কষ্টের কথা বিবেচনা করে এলাকার জলাবদ্ধ সমস্যা নিরসনের প্রত্যাশায় আমরা পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছিলাম।
২ পাখিমারা বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন করতে যেয়ে বড়ো কোন ধরনের হাঙ্গামা হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সকল ক্ষেত্রে আমরা সার্বিক সহযোগিতা করেছি।
৩ টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে জলাবদ্ধতা থেকে সকল এলাকার মানুষ উপকৃত হলেও আমরা সমস্যাক্রান্ত রয়েছি। সময়মত পর্যাপ্ত ক্ষতিপুরণ না পাওয়া, জমিতে ফসল উৎপাদন করতে না পারা এবং এলাকায় কর্মসংস্থানের অভাবে আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অভাব-অনটনের মধ্যে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে।
৪ জীবনধারণের প্রয়োজনে আমাদের অধিকাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং চরম আর্থিক সংকটে রয়েছে।
৫ জীবিকার তাগিদে অনেকেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

প্রকল্পের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য আমাদের অধিকাংশের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র জমা দেয়া আছে কিন্তু বকেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা ছাড় করা হচ্ছে না। আপনারাই পারেন আমাদের এ গভীর সংকট থেকে মুক্তি দিতে এবং আমাদের এ সমস্যার সমাধান করতে। আমরা অসহায় দরিদ্র কৃষক, এই জমিই আমাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। আপনাদের নিকট আমাদের আকুল আবেদন, আমরা যাতে ১ম পর্যায় প্রকল্পের বকেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা এবং চলমান ২য় পর্যায় প্রকল্পের ক্ষতিপূরণের টাকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহজ উপায়ে পেতে পারি তার জন্য প্রয়োজনীয় মানবিক লেখনির ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাধিত করবেন।

বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন