বৃহস্পতিবার, ২রা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ -muktinews24(তথ্য মন্ত্রনালয় কর্তৃক নিবন্ধনকৃত, রেজি নং-৩৬)

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে শীবা বাশফোঁড়ের জীবনসংগ্রাম

চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে শীবা বাশফোঁড়ের জীবনসংগ্রাম

মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক :শীবা বাশফোঁড়ের জন্ম দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বাবুপাড়া হরিজনপল্লিতে। বাবা বাবু লাল বাশফোঁড় রেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছিলেন। শীবার দুই ভাই হাটবাজার ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করেন। অভাবের কারণে দুই বোনকে কম বয়সে বিয়ে দিতে হয়েছে। শীবাও হাটে ঝাড়ু দেওয়া, নালা পরিষ্কারের কাজ করেছেন। তবে এই শীবার বর্তমান পরিচয় তিনি চীনের ইয়াংঝু বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো ইলেকট্রনিকস সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (স্নাতক) বিভাগের শিক্ষার্থী। শিক্ষাবৃত্তি নিয়েই তিনি চীনে পড়তে যাচ্ছেন আগামী শনিবার (২০ মে)।

দলিত ঘরে জন্ম, শিশুকালে মা হারানো, বাবার ছন্নছাড়া জীবন, পরিবারে খাবার জোটাই দুষ্কর—এ রকম বৈরী পরিবেশ পাড়ি দিয়ে শীবা কীভাবে এগিয়ে চলেছেন স্বপ্নের পথে, সেই গল্প মঙ্গলবার শোনালেন তিনি। জানালেন, তাঁর বাবা প্রচুর মদ খেতেন। শীবাসহ অন্য ভাইবোনদের প্রচণ্ড মারধর করে মাঝেমধ্যেই বাড়ি থেকে বের করে দিতেন। মদের দাম বেশি লিখে রাখতেন মদের দোকানের মালিক। ওই টাকার জন্য বাবা ও ভাইকে মার খেতে হতো দোকানমালিকের হাতে। মাতাল হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা বাবাকে ধরে বাড়ি আনতে হতো। ২০১৬ সালে বাবা মারা গেছেন। আর মা সরস্বতী বাশফোঁড় মারা গেছেন সেই প্রায় ২০ বছর আগে। ‘মনে হয় মাকে দেখেছি’—এটুকুই হলো মা নিয়ে শীবার স্মৃতি।

দলিত বা সমাজের চোখে অস্পৃশ্য বলে স্কুলের অন্য শিশুশিক্ষার্থীরা শীবার পাশে বসতে চাইত না। চীনের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তির পরও শীবা হোটেলে বসে কোনো কিছু খেতে পারেননি। হোটেলে ঢুকতে চাইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে তাঁর। বললেন, ‘ঢাকা শহরে আমি যে দলিত বা আমাকে কেউ চিনতে পারেনি বলে হোটেলে বসে রুটি আর চা খেতে পারলাম।’

ইয়াংঝু বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত চার বছরের বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সটিতে পড়ছেন শীবা। করোনার জন্য গত দুই বছর অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছেন। এখন তাঁকে চীনে যেতে হচ্ছে। আর্থিক কারণে ভিসা হাতে পাওয়ার পরও যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন শীবা। শীবার চেয়ে বেশি বয়সী এক আত্মীয়কে বিয়ে করলে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে এবং এ টাকা দিয়ে দেশেই যাতে কিছু একটা করেন, সে ধরনের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন শীবা। ভিসা পাওয়ার জন্য ব্যাংকে টাকা আছে, তার প্রমাণ হিসেবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিন লাখ টাকা দেখাতে হয়েছে। ওই টাকা একজন ধার দিয়েছেন। তবে তাঁর শর্ত ছিল, ৩০ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হবে। এ শর্তেই রাজি হতে হয়েছে।

তবে শীবা পাশে পেয়েছেন স্থানীয় এনজিও গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র, রাজধানীর বেসরকারি অলাভজনক সংগঠন কানেকটিং পিপল ফাউন্ডেশন-সংযোগের প্রতিনিধিদের। বড় ভাই রতন বাশফোঁড়, মায়ের মতো বড় ভাবি রিতা রানী বাশফোঁড়, ছোট বোনের স্বামী পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুমন বাশফোঁড়, পার্বতীপুর পৌর মেয়র মো. আমজাদ হোসেন, গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে ছোটবেলায় পরিচয় হওয়া শামীমা আখতার, সুইজারল্যান্ডের নাগরিক পিয়েডার কাজুরাসহ একাধিক ব্যক্তির সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। চীনে যাওয়ার জন্য উড়োজাহাজের ভাড়াসহ অন্যান্য ব্যয় বাবদ যে কয়েক লাখ টাকা লাগবে, তা এই সংস্থা ও মানুষগুলোই সংগ্রহ করে দিয়েছেন। চীনে যাওয়ার আগের কয়েক দিন ঢাকায় থাকা-খাওয়া, চীনের আবহাওয়া অনুযায়ী কাপড় কেনাসহ স্যুটকেস গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন শামীমা আখতার।

শীবা তাঁর অতীতকে কখনোই ভুলে যেতে চান না। বললেন, ‘আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখান থেকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া পর্যন্ত কত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা শুধু আমি জানি। চারপাশের মানুষের সহায়তা না পেলে এ পর্যায়ে আসা সম্ভব হতো না। এখনো কিছু মানুষ আমাদের ঘৃণা করছে, তা কাজের মধ্য দিয়ে দূর করতে চাই। মদ ও বাল্যবিবাহের হাত থেকে আমার কমিউনিটির মানুষগুলোকে রক্ষা করতে চাই।’

দিনাজপুরের পার্বতীপুরের এ বাড়িতে বড় হয়েছেন শীবা বাশফোঁড়
দিনাজপুরের পার্বতীপুরের এ বাড়িতে বড় হয়েছেন শীবা বাশফোঁড়ছবি: সংগৃহীত

বড় ভাইয়ের কাজের সূত্রে বড় ভাইয়ের পরিবার, ছোট ভাই ও শীবা পার্বতীপুর থেকে বর্তমানে রংপুরে থাকেন। রংপুরের পাগলাপীরে ভিন্ন জগৎ নামের পার্কটিতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন বড় ভাই। পার্ক কর্তৃপক্ষ একটি গুদামে থাকার জায়গা দিয়েছে। ভাই, ভাবি, ভাইয়ের দুই শিশুসন্তান, শীবা আর তাঁর ছোট ভাই সেখানেই থাকতেন। ভাইয়ের স্বল্প বেতনে এতগুলো মানুষের খাবার জোটানো কঠিন, তাই শীবা ও ছোট ভাইকেও বড় ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে।

শীবার উঠে আসা

শীবা জানালেন, গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র নামের সংস্থাটির সহায়তায় তিনি পড়াশোনা করতে পেরেছেন। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে বাবুপাড়া দলিত পিপিএস ও এনএফফি স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে খাবার, বইপত্র, স্কুলব্যাগ, সাবান, পাউডারসহ যা যা লাগে, সবই পাওয়া যেত। এ স্কুলে পড়েন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমেই শীবাসহ দলিত ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫০ শিক্ষার্থী আশ্রয় পান সংস্থাটির আলো প্রকল্পের নিবাসে। এইচএসসি পর্যন্ত এখানে থেকেই বিনা মূল্যে পড়াশোনার সুযোগ ঘটে। পার্বতীপুর সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানকার একজন শিক্ষক আহসান হাবীব চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার পরামর্শ দেন এবং সার্বিক সহায়তা করেন। তাই ডিপ্লোমা শেষ করা হয়নি। ৬ মাসের একটি কোর্স করে চাইনিজ ভাষা রপ্ত করেছেন শীবা। চট্টগ্রামের একটি চাইনিজ কোম্পানিতে কিছুদিন দোভাষীর কাজও করেছেন। শীবা পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ফলাফল করেছেন।

গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মোয়াজ্জেম হোসেন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংগঠন হেক্স সুইজারল্যান্ডের সহায়তায় নিবাসে রেখে শীবার মতো পিছিয়ে পড়া ৫০ শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র। পড়াশোনার প্রতি প্রবল ইচ্ছাশক্তি ছিল শীবার। সংস্থার পক্ষ থেকে শীবাকে সহায়তা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবার ল্যাপটপসহ শীবাকে দুই লাখের বেশি টাকা সহায়তা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে শীবার অন্য কোনো সহযোগিতা প্রয়োজন হলে তা–ও সংস্থার পক্ষ থেকে দেওয়া হবে।

হেক্স সুইজারল্যান্ডের দেশীয় পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শামীমা আখতার। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন। পরে প্রকল্পটি শেষ হয়ে যায়। জানালেন, শীবাসহ অন্যদের একদম ছোটবেলা থেকে চেনেন। শীবারা তাঁর জামা ধরে হাঁটত।

ছোট বোনের স্বামী সুমনের সঙ্গে শীবা। শীবা যাতে অনলাইনে ক্লাস করতে পারেন, সে জন্য একটি ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন সুমন
ছোট বোনের স্বামী সুমনের সঙ্গে শীবা। শীবা যাতে অনলাইনে ক্লাস করতে পারেন, সে জন্য একটি ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন সুমনছবি: প্রথম আলো

শামীমা আখতার বর্তমানে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক অফান ড্যু মন নামের আরেকটি সংগঠনের রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জানালেন, শীবাদের খোঁজখবর নিয়মিত রাখতেন। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর শীবার আর্থিক সহায়তা লাগবে, তা জানার পর ‘সংযোগ’ নামের বেসরকারি সংগঠনটির মাধ্যমে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করেন। তিনি সংযোগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শামীমা আখতার বললেন, শীবা মনের জোরে এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন। পড়াশোনা শেষ করার পর দেশে বা বিদেশে শীবার চাকরির অভাব হবে না।

পোশাক কেনাসহ ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে শামীমা আখতার বললেন, ‘শীবার তো মা–বাবা নেই। ওর পোশাকসহ বিদেশে যাওয়ার জন্য যা দরকার, তা নেই। তাই তালিকা করে সব গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে শীবাকে বলেছি, সে এখন যতটুকু পাচ্ছে, তা কমিউনিটির অন্যদের জন্য তাঁকেই ফেরত দিতে হবে।’

শীবার পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই

শামীমা আখতার সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ৭৫ বছর বয়সী পিয়েডার কাজুরাকে শীবার সাফল্যের খবর জানান। শীবাদের নিয়ে এই ব্যক্তি অনেক স্বপ্ন দেখতেন। তিনিও শীবার আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন।

বেসরকারি সংগঠন সংযোগের প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ জাভেদ জামাল প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৬ এপ্রিল শীবার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। শীবার হাতে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে মানুষের সহায়তায়।

শীবার ছোট বোনের স্বামী সুমন বাশফোঁড় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন। তবে তিনি চান, শীবা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক। তাই অনলাইনে ক্লাস করার জন্য সুমন শীবাকে একটি ল্যাপটপ কিনে দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য ল্যাপটপটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন শীবা। শীবার সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন সুমন। সুমন বললেন, দলিত কমিউনিটিকে টেনে তুলতে হলে পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। শীবার মতো একজনও যদি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, সে জন্যই সবাই মিলে শীবার পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা।

শীবা জানান, তাঁর সঙ্গে অন্য যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, ডিপ্লোমা করেছেন, তাঁদের অনেকেই বিয়ে করে এখন কয়েক সন্তানের বাবা। বাপ-দাদার পেশায় ফিরে গেছেন অনেকে। এমনকি শীবার নিজের দুই বোন পড়াশোনায় ভালো হলেও বিয়ে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

শীবা বললেন, ‘আমি পড়াশোনা করেছি বলে অনেকে বলতেন, যতই পড়াশোনা করিস, বাপ-দাদার মতো ঝাড়ুদারই হবি। মাঝে মাঝে মনে হতো আমাদের অবস্থা রাস্তার কুকুরের চেয়েও খারাপ। আমরা দেশকে পরিচ্ছন্ন রাখি, আর কিছু মানুষ এখনো আমাদের আবর্জনা মনে করে, ঘৃণা করে। আমি পড়াশোনা করে ভালো মানুষ হয়ে এমন কিছু করতে চাই, যাতে আমার কমিউনিটিতে আমি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারি।’

বিভাগ
শেয়ার করুন

মতামত লিখুন