মাশরাফির ‘ভাগ্য বরণ’ করতে চাননি তামিম
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক :
‘পাকিস্তান ম্যাচের আগে অনুশীলন করতে গিয়ে ভেবেছি, এখান থেকে আমি কবে দৌড়ে চলে আসব…!’ ঠিক এভাবেই ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাগুলো বলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
লর্ডসে সেদিন পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নামার আগেই বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত ছিল বাংলাদেশের। ফলে ওই ম্যাচ থেকে প্রাপ্তির খুব বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু সরফরাজ আহমেদের দলের বিপক্ষে সেদিন মাঠেই নামতে চাননি টাইগার দলপতি মাশরাফি।
ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপ মাশরাফির ক্যারিয়ারে ‘দুঃস্বপ্নের’ কোনো এক অধ্যায় বললেও ভুল বলা হবে না। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স বা দলের ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনা ছিল। কিন্তু মাশরাফির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল ‘টিম ম্যানেজম্যান্ট’ পরিবেশ।
২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সফল এই অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচে তো আমি স্বাভাবিক ছিলাম। দুই ম্যাচে উইকেট পাইনি এমন ঘটনা কি নেই? দর্শকরা বিশ্বকাপের মতো জায়গায় ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। মিডিয়া থেকেও কথা উঠবে। কিন্তু আমি দেখলাম, আমার চারপাশের মানুষজন পাজলড হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট বোর্ডের লোকজন কারো না কারো বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। আমাকে নিয়েই শুধু কথা। দল কিন্তু দুই ম্যাচের একটা জিতেছে এবং আমরা ভালো জায়গায় আছি। তবুও ব্যক্তিগতভাবে আমাকে নিয়েই শুধু প্রশ্ন হচ্ছে। তখন সময়ের সাথে সাথে মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকি। এমনকি পাকিস্তানের ম্যাচের আগে অনুশীলন করতে গিয়ে ভেবেছি, এখান থেকে আমি কবে দৌড়ে চলে আসব।’
আমি দেখলাম, আমার চারপাশের মানুষজন পাজলড হয়ে যাচ্ছে। ক্রিকেট বোর্ডের লোকজন কারো না কারো বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। আমাকে নিয়েই শুধু কথা। দল কিন্তু দুই ম্যাচের একটা জিতেছে এবং আমরা ভালো জায়গায় আছি। তবুও ব্যক্তিগতভাবে আমাকে নিয়েই শুধু প্রশ্ন হচ্ছে। তখন সময়ের সাথে সাথে মানসিকভাবে দুর্বল হতে থাকি। মাশরাফি বিন মর্তুজা
এখানেই শেষ নয়। বিশ্বকাপ চলাকালীনই মাশরাফি জানতে পারেন, দুইজন বোর্ড পরিচালক ইংল্যান্ডে বসেই দেশে ফোন দিয়ে একটি টিভি চ্যানেলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করতে বলেছেন। এমনকি কেউ কেউ বলেছেন, বিশ্বকাপে নাকি বাংলাদেশ দল সাড়ে ৯ জন খেলোয়াড় নিয়ে খেলেছে।
বিশ্বকাপের পরে এ ঘটনাগুলো ফাঁস করেছিলেন খোদ মাশরাফি নিজেই। আক্ষেপ করে সাবেক এই অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যত কষ্ট পেয়েছি, ওই একটা ঘটনায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি। ইংল্যান্ডে থেকেই আমাদের দু’জন বোর্ড পরিচালক কোনো চ্যানেলে ফোন দিয়ে বলেছেন, সুযোগ এসেছে মাশরাফিকে নিয়ে নিউজ করে দেন, মানুষের সামনে তাকে ভিলেন বানিয়ে দেন। এই ঘটনা জানার পরে আমি বুঝতে পেরেছি অন্যান্য খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে কত কী না হয়েছে, কত কী না হতে পারে বা হয়। আমি এটা কোনো দিন বিশ্বাস করিনি, করতে চাইওনি। সবসময় নিজেকে বলেছি, এ রকম হয় নাকি ধুর্! কিন্তু এটাই ঘটেছে।’
১৮ বছর ক্রিকেট খেলার পরে এটাই কি আমার প্রাপ্য ছিল? প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ম্যাশ। সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। মাশরাফিও মাঠ থেকে তার প্রাপ্য সম্মান নিয়ে বিদায় নিতে পারেনি।
ঠিক তার চার বছর পর আরও একটি বিশ্বকাপ। এবার দৃশ্যপটে তামিম ইকবাল। যিনি কি না, মাশরাফি ওয়ানডে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর দলের হাল ধরেছিলেন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩-এর আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন।
তামিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল ৩৭টি ম্যাচ খেলেছে। যার মধ্যে জয় পেয়েছে ২১টিতে। এই ওপেনারের হাত ধরে আসন্ন ওয়ানডে বিশ্বকাপেও অংশ নেওয়ার কথা ছিল টাইগারদের। কিন্তু ‘বিনা মেঘেই বজ্রপাতের’ মতো গত জুলাইয়ে হঠাৎ ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন তামিম। তার এই অবসরের সিদ্ধান্ত ভক্ত-অনুরাগীদের জন্য চমকে দেওয়ার মতো কোনো খবর হলেও তামিমের জন্য অবাক করার মতো কিছু ছিল না।
কারণ ফিটনেস ইস্যুতে বিগত কয়েকমাস ধরেই দলে বেশ কোনঠাসা অবস্থায় ছিলেন টাইগার অধিনায়ক। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের নাখোশ মনোভাব, বিসিবি সভাপতি পাপনের সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু মন্তব্য, অধিনায়কের ওপর টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা কমে যাওয়া…সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলেন তামিম। ফলে এই সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতেই অবসরের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
তামিমের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতিটা হয়তো এখানেই হতে পারত। কিন্তু তেমনটা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে আবারও ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। তবে দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। মাঝে দুই মাসের এক বিরতির পর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে মাঠে নামেন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক। প্রথম ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সুযোগ না পেলেও দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাটিং করেছেন তামিম। রানেরও দেখা পেয়েছেন। ৪৪ রানের সেই ইনিংসের পর পিঠের চোটের কারণে অস্বস্তি বোধ করায় তৃতীয় ম্যাচে বিশ্রামে চলে যান তিনি। বিশ্বকাপ সামনে বলেই তাকে নিয়ে কোনো ঝুঁকিও নেয়নি টিম ম্যানেজমেন্টও।
এ পর্যন্ত সবকিছুই আবারও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে যে দুইজনের অর্ন্তভুক্তি নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, সেই তামিম-মাহমুদউল্লাহ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রানের দেখা পাওয়ায় তাদের দলে থাকাও এক প্রকার নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পরে নতুন এক খবর। বিশ্বকাপে নাকি ৫ ম্যাচের বেশি খেলতে পারবেন না তামিম, তেমনটাই বিসিবিকে জানিয়েছেন তিনি। এর পেছনে নিজের ফিটনেস ইস্যুকেই দায়ী করেছেন। তবে তামিম এটাও জানিয়েছিলেন, দলে থাকলে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই খেলার চেষ্টা করবেন। তবুও তার পিঠের সমস্যার বিষয়টি যেন টিম ম্যানেজমেন্ট গুরুত্বসহকারেই দেখে।
দল ঘোষণার একদিন আগে দেশসেরা ওপেনারের এমন অবস্থান অস্বস্তিতে ফেলে টিম ম্যানেজমেন্ট ও নির্বাচক কমিটিকে। বিষয়টি জেনে বেশ বিরক্ত হন অধিনায়ক সাকিব। তিনি ও কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে সরাসরি জানিয়ে দেন, বিশ্বকাপের মতো আসরে কোনো ‘আনফিট’ ক্রিকেটারকে দলে চান না তারা। এরপরের ঘটনা সবারই জানা। তামিমকে ছাড়াই ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করেছে বিসিবি।
ঠিক এক সপ্তাহ আগেও যাকে ছাড়া বিশ্বকাপ স্কোয়াডের কথা কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও কল্পনা করেনি, সেই তামিমকে রেখেই বুধবার ভারতের উদ্দেশে উড়াল দেবে বাংলাদেশ দল। কিন্তু তামিম চাইলেই হয়তো এই বিশ্বকাপে খেলতে পারতেন। কারণ মঙ্গলবার দল ঘোষণার ৪৮ ঘন্টা আগেও দেশসেরা ওপেনারের স্কোয়াডে না থাকা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। বরং গুঞ্জন চলছিল কেবল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে। কিন্তু সোমবার রাত থেকেই পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে।
তামিমকে বাদ দেওয়ার পেছনে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ‘ইনজুরি’কে দায়ী করেছেন। তবে এই ওপেনারের চোট তো নতুন কিছু নয়। সেটি গত জুলাইয়ে তার অবসরের ঘোষণার আগেও ছিল। তবুও তাকে অবসর থেকে ফেরানো হয়েছিল। কিন্তু এখন কি আর তামিমের ওপর ভরসা রাখতে পারল না বিসিবি?
তামিম হয়তো সেই শঙ্কাটাই করেছিলেন। তাই ঝুঁকি নিতে চাননি! কেমন ঝুঁকি? ২০১৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে মাশরাফির ‘ভাগ্য বরণ’-এর সেই ঝুঁকি। তামিম জানতেন, তার সঙ্গে কোচ চন্ডিকার সম্পর্ক মোটেও ভালো যাচ্ছে না। এই ওপেনার সরাসরি বলেছেন, অবসর কাটিয়ে মাঠে ফেরার পরবর্তী এই সময়ে কোচ নাকি তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করেনি। শুধু তাই নয়, একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাকিব আল হাসানের সঙ্গেও দীর্ঘদিন ধরে কথা বলা হচ্ছে না।
এই সবকিছু মিলিয়ে ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা মোটেও তার অনুকূলে ছিল না। আর সেজন্যই বিশ্বকাপ চলাকালীন তাকে ঘিরে নতুন কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হোক, সেই ঝুঁকিটাই নিতে চাননি তামিম। বিশ্বকাপের মঞ্চে তার ‘ফিট’, ‘আনফিট’ ইস্যু দলীয় পারফরম্যান্সের চেয়েও হয়তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক আলোচনাই বেশি সৃষ্টি করতো। প্রায় ১৬ বছর ধরে দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা তামিম অতীত অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তেমন কিছুই আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই দল ঘোষণার ঠিক একদিন আগেই বিসিবিকে নিজের অবস্থান জানিয়েছিলেন।
সুত্রের খবর, অন্তরালে তামিমের ‘ইগো’র লড়াইটা শুধু সাকিবের সঙ্গেই ছিল না। ওপেনারের বিপরীতে ছিলেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন ও কোচ হাথুরুসিংহেও। বিশেষ করে, তামিমের হুট করেই অবসর নেওয়া বিসিবি বসকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছিল। এরপর মাশরাফির মধ্যস্ততায় এই ক্রিকেটারের আবারও মাঠে ফেরা পাপনের জন্য বিব্রতকর ছিল। ফলে বিশ্বকাপে তামিম যে দলে বেশ কোনঠাসা হয়ে থাকবেন সেটা এই অভিজ্ঞ ক্রিকেটার আগেই অনুমান করতে পেরেছিল।
জানা গেছে, ৭ অক্টোবর ধর্মশালায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে তামিমকে ওপেনিংয়ে ব্যাটিং করানো প্রসঙ্গেও টিম ম্যানেজম্যান্ট আস্থার সংকটে ভুগছিল। তাকে মিডল অর্ডারে খেলানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। বিষয়গুলো ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছিল এই ওপেনারের জন্য।
দলের অভ্যন্তরীন পরিবেশ তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল, অভিজ্ঞ তামিম সেটা আগেই বুঝেছিলেন। সেজন্যই কি না দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ২০২২ সালে তার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পরে এক সাংবাদিককে তামিম বলেছিলেন, ‘নিশ্চিত থাকেন, বিশ্বকাপে আমি অধিনায়ক থাকছি না। দেখবেন, বিশ্বকাপের আগে এমন কিছু ঘটবে যে আমি অধিনায়ক থাকব না।’
তামিমের সেই অনুমানই সত্যি হল। বরং শুধু অধিনায়কত্বই নয়, দল থেকেও বাদ পড়েছেন তিনি। নানা নাটকীয়তার পর দেশের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী এই ব্যাটারের আবারও অবসরের ঘোষণা হয়তো এখন কেবলই সময়ের অপেক্ষা মাত্র।