জিআই পণ্যের তালিকায় উঠছে হাঁড়িভাঙা আম
মুক্তিনিউজ২৪ ডট কম ডেস্ক : বিদায় নিয়েছে শীত, এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতিতে বইছে আগুনঝরা ফাগুনের গান। গ্রামের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে মিষ্টি ঘ্রাণ। কোকিলের কুহু কুহু কলতান আর আমের মুকুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণে আন্দোলিত চাষিদের মন। বসন্তময় ঋতু বৈচিত্র্যের এই ফাগুনে আমগাছের থোকায় থোকায় ভরা মুকুলে স্বপ্ন বুনছেন রংপুরের চাষিরা। বছরের নির্দিষ্ট এই সময় জুড়ে তাই চাষি তো বটেই, কম-বেশি সব শ্রেণির মানুষের দৃষ্টি থাকে সবুজ পাতায় ঢাকা আমগাছের শাখা-প্রশাখায়। প্রকৃতি বৈরি না হলে এবারও সাধারণ আমের পাশাপাশি হাঁড়িভাঙা আমের বাম্পার ফলনের আশা করছেন বাগান মালিক ও চাষিরা। হাঁড়িভাঙা আমের মুকুলে এবার নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন উত্তরের চাষিরা। এদিকে শতরঞ্জির পর এবার জিআই পণ্যের তালিকায় যুক্ত হতে যাচ্ছে বিখ্যাত আম হাঁড়িভাঙা। সম্প্রতি রংপুর সদরের পালিচড়া, বদরগঞ্জের শ্যামপুর, মিঠাপুকুরের খোড়াগাছসহ বিভিন্ন এলাকা যেতে দেখা মিলে সারি সারি গাছ। রাস্তার দুপাশে যেন হাঁড়িভাঙ্গা আম গাছের সবুজ বিপ্লব। ধানসহ বিভিন্ন ফসলি জমির আইলে আইলে লাগানো হয়েছে আমের গাছ। বাদ পড়েনি বসতবাড়ির পরিত্যক্ত জায়গা, পুকুরপাড়, বাড়ির উঠান। এখন বসন্ত বাতাসে আম গাছে দোল খাচ্ছে হাঁড়িভাঙা আমের মুকুল। সদ্য মুকুল ফোটার এমন দৃশ্য এখন শুধু বিস্তৃত গ্রামীণ জনপদেই নয়, শহরের গাছে গাছেও সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে আমের মুকুল। একই চিত্র মিঠাপুকুরের আখিরাহাট, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জের গোপালপুর, নাগেরহাট, সর্দারপাড়া, রংপুর সদরের সদ্যপুষ্করনী ইউনিয়নের কাঁটাবাড়িসহ আশপাশের এলাকাতেও। ইতোমধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে হাঁড়িভাঙা আম এখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ার খবরে আনন্দিত এই অঞ্চলের মানুষ। অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের কারণে গত বছর বাংলাদেশ সরকার ভারত, ব্রিটেন, তুরস্ক ও আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের এই আম উপহার হিসেবে পাঠিয়েছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও হাঁড়িভাঙ্গার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে হাঁড়িভাঙা আমের দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা কাটছে না চাষি এবং ব্যবসায়ীদের। প্রতি বছর কম বেশি শত কোটি টাকার ওপরে বিক্রি হয় হাঁড়িভাঙা আম। কিন্তু পদাগঞ্জ হাটের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন চাষিরা। তারা মনে করছেন, সঠিক সময়ে আম বাজারজাত ও পরিবহন সুবিধা বাড়ানো না গেলে অনেকেই লোকসানে পড়বেন। হাঁড়িভাঙা আমের গোড়াপত্তন করেছিলেন খোড়াগাছ ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের নফল উদ্দিন পাইকার নামে এক বৃক্ষবিলাসী মানুষ। স্বাধীনতার আগের বছর ১৯৭০ সালে নফল উদ্দিন ১২০ বছর বয়সে মারা যান। এখন তার লাগানো হাঁড়িভাঙা গাছটির বয়স ৬৮ বছর। মাতৃগাছটির সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে নফল উদ্দিন পাইকারের ছেলে আমজাদ হোসেন পাইকার বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু করে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমের মুকুল এলে কৃষকরা আম বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ঝড় কিংবা বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমের ফলন ভালো হবে। হাঁড়িভাঙা আম এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। একই ইউনিয়নের তেকানি গ্রামের আমচাষি শাহ্জাহান মিয়া। বছর দশেক আগেও তিনি শুধু ধান, ভুট্টা আর পাটচাষ করতেন। কিন্তু গ্রামে হাঁড়িভাঙ্গা আম গাছের বাগানের পর বাগান দেখে তিনিও আমের বাগান গড়ে তোলেন। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান এই আমচাষি বলেন, এবার আমের মুকুল ভালো হইচে। খালি হামার গ্রামোতে নোয়ায় এ্যলা হাঁড়িভাঙ্গা আম বালুয়া, শ্যামপুর, হেলেঞ্চ, পাইকারেরহাট, জারুল্লাপুর, খোঁড়াগাছ, গোপালপুর, সরদারপাড়া, লালপুর, পদাগঞ্জ, দুর্গাপুরসহ কয়েকটা গ্রামোত চাষ হওচে। গ্রামোত একটা বাড়িও খুঁজি পাওয়া যাবার নায় যে বাড়ির খুলিত হাঁড়িভাঙার গাছ নাই। হাঁড়িভাঙা আমকে ঘিরে বেকারের সংখ্যাও কমেছে রংপুরসহ আশপাশের কয়েকটি উপজেলায়। বিশেষত মিঠাপুকুরের লালপুর, পদাগঞ্জ, তেকানিসহ আশপাশের গ্রামের বেকার যুবকরা এখন আম ব্যবসায় জড়িয়ে বেকারত্ব দূর করেছেন। অনেকে আবার উদ্যোক্তা হিসেবে হাঁড়িভাঙার বাজার সম্প্রসারণ ও চাষাবাদ বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন। কথা হলে স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তা ও আমচাষি মেহেদী হাসান পলাশ বলেন, পড়ালেখা করে অনেক দিন ভাবছি কি করব। এখন আমি আমকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখছি। প্রথমে পরীক্ষণমূলকভাবে আম চাষ শুরু করেছিলাম। লাভবান হওয়ার পর থেকে এখন বাণিজ্যিকভাবে হাঁড়িভাঙা আমের চাষাবাদ ও ব্যবসা করছি। নিজের পাশাপাশি এলাকার অন্যদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে চেষ্টাও করছি। আখিরাহাটের বাসিন্দা আব্দুস সালাম ১৯৯২ সাল থেকে হাঁড়িভাঙ্গা আমের চাষ করে আসছেন। শুধু চাষবাদ নয়, এই অঞ্চলের হাঁড়িভাঙা সম্প্রসারণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার হাত ধরেই এ অঞ্চলের মানুষ এখন অন্যান্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভের আশায় জেলার উঁচু-নিচু ও পরিত্যক্ত জমিতে প্রতি বছর হাঁড়িভাঙা আম চাষের দিকে ঝুঁকছেন। আব্দুস সালাম সরকার বলেন, আমি প্রায় ৩৪ বছর ধরে হাঁড়িভাঙা আমের চাষ করছি। আমাকে দেখে এখন রংপুরে কয়েক লাখ হাঁড়িভাঙা আমের গাছ রোপণ করেছে আমচাষিরা। আমার ২৫টির বেশি বাগান রয়েছে। এ রকম অনেকের আম বাগান রয়েছে। পুরো জেলায় এখান প্রতি বছর প্রচুর আম উৎপাদন হয়। টেকসই অর্থনীতির জন্য আমি শুরু থেকেই হাঁড়িভাঙা আমের সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন, আধুনিক আমচাষ পদ্ধতি বাস্তবায়ন, গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনসহ হাঁড়িভাঙাকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি করে আসছিলাম। সরকার একটু দৃষ্টি দিলেই হাঁড়িভাঙাকে ঘিরেই এই অঞ্চলের অর্থনীতি আরও সচল হবে। কৃষি বিভাগ ও আমচাষিরা বলছেন, জুনের শেষ সপ্তাহে বাজারে মিলবে পরিপক্ক হাঁড়িভাঙা আম। এর আগে বাজারে হাঁড়িভাঙা আম পাওয়া গেলেও তা অপরিপক্ক হবে। হাঁড়িভাঙার প্রকৃত স্বাদ পেতে জুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে। বর্তমানে বাগানগুলোতে পরিচর্যা চলছে। নির্ধারিত সময়ে আম বাগান মালিক ও চাষিরা গাছ থেকে হাঁড়িভাঙা আম পারতে পারবেন। এরপর থেকে শুরু হবে বাজারজাত। গত বছরের চেয়ে এবার হাঁড়িভাঙা আমের লক্ষ্যমাত্রা অনেকাংশে বেড়ে যাবে বলছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল। তিনি বলেন, ঠিক গত অর্থবছরে রংপুর অঞ্চলে ২ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে হাঁড়িভাঙা আমের আবাদ হয়েছিল। গতবছরের চেয়ে এই বছর হাঁড়িভাঙা আমের ফলন বেশি আসবে। কারণ গতবছর যেই বাগানগুলো ছোট ছিল সেগুলোর ফল ধরবে এবং আমের উৎপাদন শুরু হবে। যার কারণে গত বছরের চেয়ে এই বছরে হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন বেড়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, রংপুরে হাঁড়িভাঙা আমের গাছ রয়েছে ২ হাজার ৫৩৭ হেক্টর জমিতে। যেখানে গত বছর উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৩৫ হাজার মেট্রিক টন আম। হাঁড়িভাঙার সবচেয়ে বড় যেটা খবর সেটা হচ্ছে বিগত কয়েকবছর যাবৎ আমরা এই পণ্যটাকে কৃষি বান্ধব সরকারের যে বিভিন্ন কৃষি পণ্য জেলায় জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণা হতে যাচ্ছে তার প্রক্রিয়ার মধ্যে রেখেছি। অন্যদিকে উত্তরের অর্থনীতিতে হাঁড়িভাঙা আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বলে জানান রংপুরের জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, প্রতি বছর হাঁড়িভাঙা আমের বাম্পার ফলন হয়। এবার হাঁড়িভাঙা আম নিয়ে সুখবর রয়েছে। কারণ জিআই পণ্য ঘোষণা হওয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। খুব দ্রুত ভালো খবর পাব আশা রাখি। তিনি আরও বলেন, এটার কার্যক্রম প্রায় সমাপ্তের পথে। আগামী দুই মাসের মধ্যে হাঁড়িভাঙার আম জিআই পণ্যে রূপান্তরিত হওয়ার অফিশিয়াল ঘোষণা আসবে।