ভিক্ষা নয় পরিশ্রমই যার নেশা পঙ্গু দিনমজুর শাহ আলীর
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ ভিক্ষা নয় পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করছেন এক হাত বিহীন দিনমজুর শাহ আলী (৪৪)। জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই যোদ্ধার উপর নির্ভরশীল পরিবারের চার সদস্যের। শাহ আলী পেশায় একজন দিনমজুর। ঘরে চার মেয়ে সন্তান ও এক স্ত্রী আকলিমা বেগমকে নিয়ে তার সংসার।পরিবারের উপার্জনকারী এক মাত্র শাহ আলী। তার দিনমজুরির আয়ে কোন রকম চলে পরিবারটি।এলাকায় কাজ না থাকলে ছুটেন ঢাকা, টাঙ্গাইল, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। লেখাপড়া না থাকায় কৃষি কাজ করে যে টাকা উপার্জন করতেন তা দিয়ে বেশ ভালোই চলছিল পরিবারটির। প্রায় তিন বছর আগে বগুড়ায় এক সড়ক দূর্ঘটনায় শাহ আলী হারিয়ে ফেলেন তার বাম হাতটি। একই বছরে একমাত্র সম্বল বসতভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।জীবনের এমন পরিস্থিতিতে অসহায় হয়ে পড়েন।পুরো পরিবার জুড়ে নেমে আসে অন্ধকার।তবে তিনি থেমে থাকেননি। নিজেকে প্রতিবন্ধি না ভেবে এক হাত নিয়েই ধরেন সংসারের হাল। যদিও আগের চেয়ে তার উপার্জন কমেছে তবুও পরিবারকে বাঁচাতে দিন রাত পরিশ্রম করে চলছেন শাহ আলী।
শাহ আলীর বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়াল ডাঙা ইউনিয়নের গতিয়াশাম গ্রামে। তার বাবা সাইয়েদ আলী। বর্তমানে ঘরবাড়ি হারিয়ে তিস্তা নদী দ্বারা চারদিক বেষ্টিত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ চরখিতাব গ্রামে অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন।
শাহ আলী জানান,আমার জমি জমা বলতে১৬ শতক ভিটেমাটি ছাড়া কিছু ছিল না। অন্যের বাড়িতে কাজ কর্ম করে সংসার চলতো। এলাকায় কাজ না থাকলে জেলার বাইরে ধান কাটতে যেতাম। ২০২১ সালে বগুড়া ধান কাটতে যাই। সেখানে সিএনজিতে করে বাম দিকে বসে এক হাত বের করা ছিল। পথে ট্রাক আর সিএনজির ধাক্কায় আমার বাম হাতটি রাস্তায় পড়ে যায়। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে সাথের লোকজন আমাকে বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। এক মাস চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি চলে আসি। ক্ষত না শুকাতেই শুরু হয় নদী ভাঙন।এক রাতেই তিস্তা নদী আমার ভিটেমাটি কেড়ে নেয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় দ্বীপ চরে বছরে ৫হাজার টাকা ভাড়ায় ১০শতক জমিতে কোনো এরকমে পরিবার নিয়ে বসবাস করছি। চার মেয়ে এবং স্ত্রীসহ ছয়জনের সংসার।
এরমধ্যে দুটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখন চারজনের ভরনপোষণ আমার এক হাতের উপর নির্ভরশীল। আমি এই এক হাত দিয়ে ধান কাটা-মাড়াই,মাটি কাটা-নিরানি,ইট ভাঙাসহ বিভিন্ন কাজ করে থাকি। তবে আমার এক হাত নেই বলে আগের মতো কেউ আর কাজে নিতে চায়না। তাই এই চরের মধ্যেই কাজ করে খেয়া না খেয়ে দিন চলছে। শরীরে যতক্ষণ শক্তি আছে ততক্ষণ কাজ করে যাবো। তবুও ভিক্ষাবৃত্তির মতো নিচু কাজ করবো না।
শাহ আলীর স্ত্রী আকলিমা বেগম বলেন,আগে মোটামুটি ভালো ছিলাম।স্বামীর হাত হারানোর পর প্রায় তিন বছর ধরে আমরা কষ্টে আছি।সরকার তিনমাস পর দুই হাজার দুই শত টাকা প্রতিবন্ধি ভাতা দেয় এবং এলাকায় কৃষি কাজ করে তা দিয়ে চলেছে সংসার।প্রতি বছর ৫হাজার টাকায় ১০শতক জমি ভাড়া নিয়ে বাড়ি করে আছি। আমাদের চারটা মেয়ে একটা ছেলে সন্তান নাই যে সংসারের হাল ধরবে।কষ্ট হলেও ওই মানুষটার এক হাতের উপর ভরসা ছাড়া উপায় নেই।দিন যতই যাচ্ছে সংসারে খরচ বাড়ছে দুঃশ্চিন্তাও বাড়ছে।আল্লাহ জানে-ভবিষ্যতে আমাদের ভাগ্যে কি আছে?
প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম বলেন, শাহ আলী ও তার পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছে।এক হাতের উপর চলছে পুরো সংসার। মেয়ের লেখাপড়া খরচ ও পরিবারের খরচ যোগান দিতে না পারায় মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। সরকার যে প্রতিবন্ধি ভাতা দেয় তাই দিয়ে কি আর এতগুলো মানুষের জীবন চলে।
ঘড়িয়াল ডাঙা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আঃ কুদ্দুস বলেন,দূর্ঘটনায় এক হাত হারিয়ে শাহ আলী পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে আছেন।তার নামে প্রতিবন্ধি ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি বেসরকারি ভাবে পরিবার চলার মত কোন সহযোগিতা পেলে হয়তো তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হতো।
জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বলেন,দূর্ঘটনায় হাত হারানো শাহ আলীর বিষয় জানতে পারলাম। আরও খোঁজ খবর নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সহায়তাসহ তাকে কিভাবে স্বাবলম্বী করা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।